পানির জন্য সাঁওতাল কৃষকের বিষপান ও জনজিজ্ঞাসা
রাজশাহীর গোদাগাড়িতে সেচের পানি না পেয়ে দুইজন আদিবাসী সাঁওতাল কৃষক রবি মারান্ডি (২৭) ও অভিনাথ মারান্ডি (৩৬) বিষ পানে আত্মহত্যা করেছে। খবরটি সামাজিক গণমাধ্যমে আসার পর অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করতে হলো?
আমাদের দেশে সম্প্রতি এই ঘটনা সামনে আসলেও কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা আজ নতুন নয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে কৃষকের আত্মহত্যার খবর অহরহ। ২০১৯ সালের এনসিআরবি (NCRB)-এর পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে ভারতে ১০ হাজার ২৮১ জন কৃষক এবং ৩২, ৫৫৯ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করেছে। এ হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আফ্রিকার দিকে তাকালেও এরকম ঘটনার ভুরি ভুরি নিদর্শন পাওয়া যাবে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা এরআগে হয়তো এভাবে সামনে আসেনি। তবে অভি-রবি মৃত্যু জনমনে নতুন জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছে। অভিনাথ মারান্ডি নিজের জমি না থাকায় বর্গা জমিতে চাষ করতেন। জমিতে সেচ দেওয়ার পর কীটনাশক প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পানিকলের অপারেটরের কাছ থেকে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।
অবশেষে পানি না পেয়ে দুইভাই অভি এবং রবি একসাথে গভীর নলকূপের সামনে দাঁড়িয়ে বিষ পান করেছেন। বিষপানের ঘটনাটি ঘটেছে ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবসের পরের দিন ২৩ মার্চ সন্ধ্যায়। রাতেই অভিনাথের মৃত্যু ঘটে। রবির মৃত্যু ঘটেছে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের দিন রাতে।
বিষপানের কথা তারা অপারেটরকে জানিয়েছিল। কিন্তু তারপরও অপারেটর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি তাদেরকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থাও করেনি। সে তাদেরকে একটা ভ্যানে তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বাড়িতে যখন পৌঁছেছে তখন তারা অর্ধমৃত। হাসপাতালে নেওয়ার পর কথা বলার শক্তি প্রায় রহিত। এ সময় সাংবাদিকরা বিষ পানের কারণ জানতে চাইলে রবি মারাণ্ডি শুধু একবার বলেছিলেন, ‘দুঃখ লেগেছিল।’
অভিনাথ মারান্ডি নিজের জমি না থাকায় বর্গা জমিতে চাষ করতেন। জমিতে সেচ দেওয়ার পর কীটনাশক প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পানিকলের অপারেটরের কাছ থেকে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।
গভীর নলকূপের পানি বণ্টনের দায়িত্বে নিয়োজিত অপারেটরের নামে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও সে সেখানে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এ দায় কি শুধু অপারেটরের? বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ এ দায় এড়াবেন কীভাবে?
কিন্তু দুজন কৃষকের আত্মহত্যার পর তাদের অন্তরাত্মায় কি কোনো অনুশোচনার প্রতিফলন দেখেছি? বরং এই ঘটনার পর বিএমডিএ-এর অতিরিক্ত পরিচালক বলেছেন, ‘পানির অভাবে তাদের ধান মারা যায়নি। আর সেই শোকে তারা বিষ পান করেছেন-এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।’
গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘চৈত্রমাসে আট-দশ দিন জমিতে পানি দিতে না পেরে একজন মানুষ বিষ খেয়ে মারা যেতে পারে? বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে, ময়নাতদন্তের পর ঘটনার কারণ জানা যাবে।’
ময়না তদন্ত হবে, তদন্ত কমিটি তদন্ত করবেন। তদন্ত রিপোর্ট টেবিলে ফাইলের নিচে চাপা পড়ে যাবে। থেমে যাবে চারিদিকের এই সরবতা। আমরা ভুলে যাব, অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডির কথা। অথচ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত পবিত্র সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশে লেখা আছে শোষণমুক্তি, আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার ইত্যাদি নিশ্চিত করার কথা।
অঙ্গিকার নামায় লেখা আছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ নিশ্চিত করবো। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আদিবাসী, গরিব, প্রান্তিক কৃষক কেন এত অবহেলা-বঞ্চনার শিকার?
ভূমি হারাতে হারাতে সাঁওতালরা এখন ভূমিহীন কৃষক। নিজের জমি নিজেদেরই বর্গা নিতে হয়। বরেন্দ্র এলাকার বর্গা নেওয়া সেই লাল মাটিতে রবি-অভিরা ফসল ফলান। একে তো বর্গা জমি তারপর আবার ফসল ফলাতে করতে হয় ঋণ। জীবনপাত করে ঋণের টাকায় ফলানো ফসল যখন নিজের চোখের সামনে পানির অভাবে নষ্ট হতে থাকে তখন দুঃখ যে কতটা ভারী হয়ে ওঠে তা কি করে বুঝবেন আমাদের পরজীবীরা। এটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, অভি এবং রবির ঘরে টানা তিনদিন চুলা জ্বলেনি। ঘরে চাল ছিল না। টিকে থাকার স্বপ্ন ছিল ঋণের টাকায় বর্গা জমিতে চাষ করা ধান। চোখের সামনে সে ধানের জীবনাবসান দেখার পর তাদের কাছে বেঁচে থাকার আর কীই-বা মানে? তাই দিনের পর দিন ঘুরে সেচের ব্যবস্থা করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া তারা।
ভূমি হারাতে হারাতে সাঁওতালরা এখন ভূমিহীন কৃষক। নিজের জমি নিজেদেরই বর্গা নিতে হয়। বরেন্দ্র এলাকার বর্গা নেওয়া সেই লাল মাটিতে রবি-অভিরা ফসল ফলান। একে তো বর্গা জমি তারপর আবার ফসল ফলাতে করতে হয় ঋণ।
শুধু আদিবাসী জনগোষ্ঠী না সেখানকার ক্ষুদ্র কৃষকরাও চাহিদা অনুযায়ী পানি পাচ্ছে না। এ অঞ্চলের ভূ-উপরিস্থ পানির আঁধারগুলো অনেক আগেই বিলীন হয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপরেই এখন টিকে আছে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের জীবন-মরণ, কৃষি কাজ, দৈনন্দিন ব্যবহার্য পানির আঁধার, সব। ভূগর্ভস্থ এ পানির নিয়ন্ত্রণ বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) কাছে।
তারা কিছুদূর পরপর মেশিন ঘর স্থাপন করে রেখেছে এবং সেখান থেকে পানি কিনে নিতে হয় সবাইকে। এই সুযোগে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি পানি ব্যবসায় নেমে পড়েছে। ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, নারী ও আদিবাসী কৃষক তাদের সময় বা প্রয়োজন মতো পানি পাচ্ছে না। তারা কৃষকদের জন্য এক নিয়ম এবং কর্পোরেট কোম্পানির জন্য আর এক নিয়ম চালু করেছে। এই এলাকায় প্রাণ-সেজানসহ বিভিন্ন কারখানায় এবং চালের কলের জন্য ব্যাপকভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। সেদিকে কর্তৃপক্ষের নজর নেই। অন্যদিকে পানিশূন্যতায় জমি চৌচির হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে রক্ত পানি করা ফসল মারা যাচ্ছে।
দুজন কৃষকের আত্মহত্যার মাধ্যমে পানির বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হলেও বরেন্দ্র এলাকার সমস্যার গভীরতা আরও প্রকট। কৃষক প্রতিমূহুর্তে প্রতারিত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে। সেখানে কৃষি জমি কিনে প্লটের ব্যবসা হচ্ছে। ব্যাপক কৃষি জমিতে ফলের বাগান বা পুকুর তৈরি করা হচ্ছে। অনেক সময় নামমাত্র দামে বা জোর করে ক্ষুদ্র কৃষকের জমি দখল করে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব ব্যাপারে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডি)-এর কোনো মনোযোগ নেই।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে বিএমডি’র চেয়ারপার্সনসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দায়িত্বে থাকার এখতিয়ার আছে কি? প্রতিনিয়ত উন্নয়নের যে গালভরা বুলি আমরা ছড়াচ্ছি এই ঘটনা কি তার মুখে ঝামা ঘষে দেয়নি? অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডি জীবন দিয়ে কি আমাদের সামনে কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে যায়নি? এই উত্তর খুঁজে বের করা এখন সময়ে দাবি।
অমিত রঞ্জন দে ।। সংস্কৃতিকর্মী ও সহ-সাধারণ সম্পাদক, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ