যশোরে প্রকাশ্যে নারীকে মারধর : নিরাপত্তা কোথায়?
যশোরে বন্ধুর বাইসাইকেলে চড়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে কিশোরীকে মারধর ও ভিডিও ধারণ, জামালপুরের আশামনির আত্মহত্যা, ঢাকায় বাসে কিশোরীকে টি-শার্ট পরার জন্য হেনস্থা ও অপমান, সৃজা নামের কিশোরীর আত্মহত্যা কারণ তার পোশাক ও চলাফেরা নিয়ে বাবা মায়ের কাছে প্রতিবেশীদের নিন্দা এবং বাবা মায়ের দুর্ব্যবহার- মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই ঘটনাগুলো আমাদের ঘুমিয়ে থাকা আত্মাকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দিয়ে গেছে।
এই ঘটনাগুলোর ভেতরে আপনি কি কোনো মিল খুঁজে পান? কোনো সংযোগ কিংবা পারস্পরিক বোঝাপড়া, মানে যারা এসবের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন, আপনি কি সেই মুখগুলোকে চিনতে পারছেন? অথবা চেনা চেনা লাগেছে?
বিজ্ঞাপন
যদি আপনার কাছে মনে হয়, ‘প্রতিটি ঘটনাই স্বতন্ত্র’ কিংবা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, তবে আপনি সেই ক্ষমতার স্বর্গে নিরোর বাঁশি নিয়ে বসে আছেন। আপনাকে এই নিদারুণ বেদনাগুলোর গপ্পো বলে আর বিব্রত করা ঠিক হবে না। কিন্তু আপনি যদি আপনার বিবেক ও বুদ্ধিকে এখনো সম্পূর্ণ খুইয়ে না থাকেন, তবে দেখবেন এবং ঠিক বুঝে নিতে পারবেন, এই ধারাবাহিক ঘটনাক্রমের ভেতরের পারস্পরিক যোগাযোগটা কোথায়। মিল আসলে কই।
মৌলবাদ যখন ঘাঁটি গেড়ে বসতে চায়, সবার আগে তার টার্গেট হয় নারী। যুগে যুগে নারীর প্রতি খড়গ নামিয়ে আনার ভেতর দিয়ে মৌলবাদী পুরুষতন্ত্র কর্তৃত্ব মজা নিতে চেয়েছে। কারণ সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নারী এমনিতেই বঞ্চিত, অবহেলিত, নিপীড়িত এবং তাকে শোষণ করার সহজ সুযোগ চারপাশে ছড়ানো।
পরীক্ষায় নারী দারুণ ফলাফল করছে। নারী শিক্ষিত হচ্ছে। কর্মক্ষম হচ্ছে। নারী অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। নারী সচেতন হচ্ছে। নারী শক্তিশালী হচ্ছে। এত এত ফতোয়া, ওয়াজ, খুতবার পরও নারীর এই অগ্রযাত্রা যেন অপ্রতিরোধ্য।
রাষ্ট্র সেই পথকে সহজ করেছে, ধর্ম ও সমাজনীতি নিপীড়ক পুরুষের হাতকে আরও শক্তিশালী করেছে। এহেন পরিস্থিতিতে মৌলবাদের জাল বিস্তারের জন্য সবার আগে নারীকে ধরাশায়ী করা যায়। ফতোয়া দেওয়া যায়। নতুন নতুন আইন দেখানো যায়। এবং এর ভেতর দিয়ে পুরো সিস্টেমকে আয়ত্তে নিয়ে আসা সম্ভব হয়।
মৌলবাদের এই চাল নতুন নয়। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, ইরানে- সর্বত্র আমরা এর জ্বলন্ত উদাহরণ প্রত্যক্ষ করেছি। বাংলাদেশে মৌলবাদীদের টার্গেটেও নারীরা একেবারে প্রথম সারিতে। নারীকে বোরকা পরতে হবে, নারীকে হিজাব করতে হবে। নারীর শিক্ষার প্রয়োজন নেই। স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকার নেই। নারীর উপার্জন করার দরকার নেই।
ঘরের বাইরে যাওয়ার অধিকার নেই। মধ্যযুগীয় আইন প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপেই নারী—যাকে লক্ষ্য রেখে আইন প্রতিষ্ঠা করে মৌলবাদের শিকড় বিস্তারের অভিপ্রায় নিয়ে গত কয়েক যুগ ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একটি মহল। এবং এই মৌলবাদী মহলের সাথে লড়াই করেই নারীমুক্তির পথটা আমাদের হাঁটতে হচ্ছে। পুরুষতন্ত্র ও মৌলবাদ—এই দুই ভাইয়ের নানামুখী কূটকৌশলকে রুখতে রুখতেই আমাদের শক্তিক্ষয় হচ্ছে। আমাদের যুদ্ধের শেষ নেই। এবং যুদ্ধে কেউ পাশেও নেই। যুদ্ধ নারীর একার।
নারীমুক্তির কথাটা এখন জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে বলে মৌলবাদীরা একটু বিপাকে। এমনকি নারীবাদ শব্দটিকে নানাভাবে বিভ্রান্তির ভেতরে ফেলার চেষ্টা করেও তারা সফল হতে পারেনি। নারীবাদের আলোকিত রূপটি ঠিকই মানুষকে নাড়া দিতে শুরু করেছে। অথচ তারা কিন্তু চেষ্টার কমতি রাখেনি।
গ্রামে মফস্বলে শহরে ক্রমাগত ওয়াজ করে করে তারা নারীর প্রতি ঘৃণা ছড়িয়েছে এবং এখনো ছড়াচ্ছে, মসজিদে নামাজের শেষে খুতবায় কিছু ইমামের নারী-বিদ্বেষী বক্তব্য শুনলে অবাক হবেন। তবু নারীকে আটকে রাখা যাচ্ছে না।
পরীক্ষায় নারী দারুণ ফলাফল করছে। নারী শিক্ষিত হচ্ছে। কর্মক্ষম হচ্ছে। নারী অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। নারী সচেতন হচ্ছে। নারী শক্তিশালী হচ্ছে। এত এত ফতোয়া, ওয়াজ, খুতবার পরও নারীর এই অগ্রযাত্রা যেন অপ্রতিরোধ্য। ধর্ষণ করে, ইভটিজিং করে, ফতোয়া দিয়ে, নির্যাতন করেও নারীর এগিয়ে যাওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। নারীর নিজের নেওয়া সিদ্ধান্ত বদলে দেওয়া যাচ্ছে না।
নিজের সন্তানকে মৌলবাদীর শিকারে পরিণত হতে দেবেন না। সবসময় মেয়েটির পাশে থাকুন। মেয়েটিকে সমান মর্যাদা ও অধিকার দিয়ে বড় করুন। আর মৌলবাদীর ফতোয়ার বিরুদ্ধে দাঁতভাঙা জবাব দিন।
নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না যেকোনো অন্ধবিশ্বাস কি আইন। এই লড়াই যেন দু’মুখী। একদিকে নারীকে নির্যাতন করেই চলেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ; অন্যদিকে বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে সংগ্রামী নারীরা। এক কূল ভাঙে তো আরেক কূল গড়ে ওঠে। তো নারীর এই দুর্বার লড়াইকে আটকাতে হবে তো! হয়তো সেকারণেই মৌলবাদীরা বেছে নিচ্ছে কিশোরী মেয়েদের, যাদের আমরা বয়ঃসন্ধি (Vulnerable Age) গ্রুপ বলি।
বাসে একটি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে পোশাক নিয়ে আক্রমণ করাটা ঝুঁকিপূর্ণ। বরং একটি কিশোরীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়াটা সহজ। আবার তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে হবে। আরেকটি নারীকেই, যাতে সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো সোজা হয়। সমাজ ভাবল, বাহ নারীই তো বলেছে আরেক নারীকে। পুরুষ নয়। বিভ্রান্ত করার কি এক নতুন চক্রান্ত।
নারীর পোশাক মৌলবাদীদের সবচেয়ে বেশি মাথা ব্যথার জায়গা। তাই দেখবেন প্রতিটি ঘটনাতেই নারীর পোশাক হয়ে উঠেছে মুখ্য। নারী কেমন পোশাক পরবে, তা ঠিক করবে ওরা। নারী নিজে না। অথচ নারীরা আজকাল তার পরোয়া করছে না। একটি বিরাট সংখ্যক নারী নিজের সিদ্ধান্তে পোশাক পরছে, ওদের সামনে দিয়ে মাথা উঁচু করে হেঁটে যাচ্ছে- এর যে জ্বালা, যে যন্ত্রণা তা আর কত সহ্য হয়! অতএব আটকাও। কীভাবে আটকাবে! প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষিত কর্মজীবী মেয়েদের আটকে দেওয়া কঠিন। তাহলে আটকাও ওই বাচ্চা মেয়েগুলোকে, যারা বয়ঃসন্ধিতে আছে। ওদের বাবা মাকে অপমান করো। ওদের নিষেধ করো। ওদের বিপদে ফেলো। ওদের শাসাও। তাহলেই অর্ধেক কাজ হয়ে যায়।
নারী অবলা—এই বাক্যটি প্রয়োগ করে করে নারীকে কোণঠাসা করে রেখেছে সমাজ বহু বহুকাল। আজ নারী এই অবলা শব্দটির মুখে চড় কষিয়ে সামনে এগোতে শুরু করেছে। তাকে আটকানো কঠিন হয়েছে তাদের জন্য। তাই সদ্য শৈশব পেরুনো মেয়েদের কোমলতাকে পুঁজি করে ওরা মাঠে নেমেছে।
সময়টা কঠিন। শত্রু যদিও পুরনো। ওদের চক্রান্ত নতুন। কিন্তু টার্গেট সেই একই। তাই সাবধান হন। বিশেষ করে বাবা মায়েরা। নিজের সন্তানকে মৌলবাদীর শিকারে পরিণত হতে দেবেন না। সবসময় মেয়েটির পাশে থাকুন। মেয়েটিকে সমান মর্যাদা ও অধিকার দিয়ে বড় করুন। আর মৌলবাদীর ফতোয়ার বিরুদ্ধে দাঁতভাঙা জবাব দিন। হোক সে মৌলবাদী আপনার প্রতিবেশী, আত্মীয়, বন্ধু কী সহকর্মী। হোক সে বাসের সহযাত্রী। যেখানেই তাকে যেকোনো মেয়ের বিরুদ্ধে ফনা তুলতে দেখবেন, সাথে সাথে বিষদাঁত তুলে নেবেন। এই হোক আগামীর অঙ্গীকার।
শারমিন শামস্ ।। সম্পাদক, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর