ছবি : সংগৃহীত

‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি হে ক্ষণজন্মা নেতা,
তোমার জন্যই পেয়েছি মোরা প্রাণের স্বাধীনতা।
তুমি না হলে বাংলাদেশ হতো না হে চিরঞ্জীব নেতা,
তাই বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একই সুতোই গাঁথা।
শুভ জন্মদিন জাতির পিতা।'

                                                                                   বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন —আবু জাফর

১৭ মার্চ বাংলাদেশের রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫ ) এর জন্মবার্ষিকী। তাকে শেখ মুজিব বা সহজভাবে মুজিব, ‘বঙ্গবন্ধু’ বা ‘বাংলার বন্ধু’ হিসেবে ছোটবেলা থেকেই জেনে আসছি। তার সেই প্রতিচ্ছবি যেন দুর্গা প্রতিমার মতোই বুকে ধারণ করে আছি এবং আমরণ থাকবো। তার সেই বজ্রকণ্ঠ যেন মেঘের গর্জনের মতো মহা হুংকার দিয়ে আজও শত্রুকে ভয় দেখায়।

যে নেতার জন্ম না হলে তৈরি হতো না একটি স্বাধীন জাতি, একটি দেশ বা বাংলায় কথা বলার একটি বিশ্ব পরিসর। আমাদের বাঙালি জাতিকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আত্মপরিচয়ের এক অগ্নি মশাল হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই অবিনশ্বর নেতা।

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা, পরম্পরায় বাংলাদেশ 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এমন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যখন ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জে মাত্র ৪০ মাইল দূরত্ব যেতে একদিন সময় লেগে যেত। তিনি ছিলেন শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের তৃতীয় সন্তান।

শেখ মুজিব যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করে বড় হয়েছেন সেটা তার বাবা নিজেই তৈরি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারে এক ভাই শেখ নাসের এবং চার বোন ছিল এবং তার বাবা-মা তাকে স্নেহ করে ‘খোকা’ (ছোট ছেলে) বলে ডাকতেন।

সাত বছর বয়সে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন এবং দুই বছর পর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ওখান থেকে ১৯৩১ সালে তিনি মাদারীপুর ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৯৩৪ সালে ১৪ বছর বয়সে স্কুল থেকে অনেকটা বিরত থাকতে হয় কারণ তার একটি চোখে সমস্যা দেখা দেওয়াতে জরুরি চোখের অপারেশনের জন্য তাকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

আরও পড়ুন : রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!

চোখের অপারেশনের পর শেখ মুজিবুর রহমান মাদারীপুরে ফিরে আসলেও কিছু সময়ের জন্য তেমন কিছুই করার ছিল না। পড়াশোনা নেই খেলাধুলা নেই। সন্ধ্যায় সভা-সমাবেশে যাওয়া ছিল তার একমাত্র পথ। তখন ছিল স্বদেশি আন্দোলনের সময় যা মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।

মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশদের আতঙ্কিত করে তুলেছিলেন যাতে বঙ্গবন্ধু খুব অনুপ্রাণিত হন। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলে গেছেন যে, তিনি মনেপ্রাণে ব্রিটিশদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন। তার মনে হয়েছিল ইংরেজদের এই  দেশে থাকার কোনো অধিকার নেই। আর তাই স্বাধীনতা অর্জন করতে তিনিও নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন  এবং বিভিন্ন সভায় সমাবেশে যোগদানের জন্য গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন। 

বঙ্গবন্ধু ১৯৩৯ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ছাত্র থাকাকালীন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হন। তিনি যখন প্রথমবার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং আওয়ামী লীগ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুখোমুখি হন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর।

আরও পড়ুন : ধর্ম যার যার থাকুক, উৎসব হোক সবার

যখন তারা একটি জনসভার জন্য গোপালগঞ্জে যান এবং সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের আগমনের প্রস্তুতিতে স্কুলের ফাটল ছাদ মেরামত করার দাবিতে একদল ছাত্রের নেতৃত্ব দিয়ে সবার নজরে আসেন। পরের বছর ১৯৪০ সালে বঙ্গবন্ধু নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে (সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন) যোগ দেন এবং এক বছরের মেয়াদে সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে তার প্রবেশিকা (বর্তমানে এসএসসি বা মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক বিষয়ে পড়ার জন্য তিনি কলকাতার স্বনামধন্য ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ), ইন্টারমিডিয়েট ছাত্র (দ্বাদশ শ্রেণি) হিসেবে ভর্তি হন। সেই সুবাদে তিনি তখন বেকার হোস্টেলে থাকতেন এবং ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হন।

বঙ্গবন্ধু ১৯৪৩ সালে (বেঙ্গল) মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং তার সাথেই তিনি সোহরাওয়ার্দীর ধারার রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার নেতৃত্বাধীন সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ হন। এই সময়কালে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে পৃথক একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা নিয়ে লীগের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করতে থাকেন।

আরও পড়ুন : অসাম্প্রদায়িক জাতির দেশ 

১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত ফরিদপুরে অবস্থিত কলকাতা কেন্দ্রিক সংগঠন অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন যেখানে তিনি ফরিদপুর জেলা অ্যাসোসিয়েশন সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। দুই বছর পরে, তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ভারত বিভাগের ঠিক আগে ১৯৪৬ সালে কলকাতায় যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয়েছিল সেই সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অধীনে কাজ করা মুসলিম রাজনীতিবিদদের অন্যতম হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু।

জানা যায়, বঙ্গবন্ধু  রাজনীতিতে যোগদানের আগে, কলকাতা ও ঢাকায় আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন করেন এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে যোগ দেন যা তাকে পূর্ব পাকিস্তানের একজন জনপ্রিয় নেতা হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।

ছয় দফা আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করাসহ ১৯৭০ সালে তার দল পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। দেশের এই প্রথম ঐতিহাসিক ঘটনা যেখানে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সব দলের চেয়ে বেশি আসন জিতেছিল আওয়ামী লীগ। বিষয়টি পাকিস্তানি নেতারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি।

আরও পড়ুন : সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের দিনটি ছিল তার জীবনের এক চরম পরীক্ষার দিন। মুক্তির যুদ্ধে তাদের নেতার নির্দেশ শোনার জন্য সেদিন প্রায় ২০ লাখ স্বাধীনতাকামী মানুষ রমনা রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয় (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাও তাকে ফাঁদে ফেলতে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে জনগণকে গুলি করার জন্য অপেক্ষা করছিল।

চারদিকে যেন এক মৃত্যুফাঁদ। কী হবে, কী হয় কেউ জানে না। মুহূর্তেই গর্জে উঠে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ কিন্তু নিপুণভাবে হিসেব করা সংযত ভাষায়। সভায় তার ঐতিহাসিক ঘোষণা ছিল, ‘আমাদের এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। আমাদের এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে আক্রমণের অজুহাত অস্বীকার করার জন্য, তিনি সাংবিধানিক উপায়ে সংকটের সমাধানের জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করার সযত্ন পরামর্শ দেন এবং আলোচনার দরজাও খোলা রাখেন।

তবে আক্রমণ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শুরু হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাক সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে শেষবারের মতো গ্রেপ্তার করে এবং তাকে পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল বন্দি করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়।

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন 

বিদ্রোহ দমনের নামে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের সর্বত্র নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের উপর নারকীয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নির্বিচারে গণহত্যা চালায় যা ত্রিশ লাখেরও বেশি নর-নারী ও শিশুকে হত্যা করে, লক্ষাধিক নারীকে ধর্ষণ করে এবং কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস করে বা লুট করে নিয়ে যায়।

তাদের লজ্জাজনক পরাজয় এবং আত্মসমর্পণের আগে তারা তাদের স্থানীয় সহযোগীদের (রাজাকার) সহায়তায় অনেক বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, লেখক, ডাক্তার, সাংবাদিক, প্রকৌশলী এবং অন্যান্য পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যা করে। একটি দগ্ধ অর্থনীতি অনুসরণ করে, তারা কার্যত দেশের সমগ্র অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছে।

এতকিছুর পরেও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য চেতনাকে ধ্বংস করতে পারেনি, অগ্নিনেতার বজ্রকণ্ঠকে স্তব্ধ করতে পারেনি। পরাজয় মেনে নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ এবং নিজস্ব অভ্যন্তরীণ দুর্দশার বাধ্যবাধকতায় বাধ্য হয়ে পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে মহান নেতা তার প্রিয় ভূমি এবং তার প্রশংসিত জাতিতে ফিরে আসেন। হয়ে উঠেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক