মহানায়ক জন্মেছিলেন বলেই
‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না।’ এভাবেই নিজের দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং পরবর্তীতে এদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। জনসাধারণের কাছে তিনি ১৯৬৯ সালে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন।
বিজ্ঞাপন
১৯২০ সালের এই দিন। হাজার বছরের অন্ধকার ভাঙতে জন্ম নিয়েছিল এক আলোকশিশু। যার জন্মের সঙ্গে একটি জাতির ভাগ্য লেখা হয় মুক্তির সনদ; যার কান্নায় ধ্বনিত হয় যুগ-যুগের পরাধীনতার আর্তনাদ! সারাবিশ্ব দেখেছে, সেই শিশুই একদিন জাতিকে পথ দেখায় মুক্তিচেতনার মশাল হাতে, এনে দেয় স্বাধীনতা!
সেই বাঙালি মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন আজ। বাংলা বাঙালি বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। মুক্তিকামী মানুষের স্লোগানের নাম শেখ মুজিব। বাঙালি জাতির চেতনার ধমনিতে প্রবাহিত শুদ্ধতম নাম শেখ মুজিব। তিনি চিরন্তন-চিরঞ্জীব; বাঙালির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে অবিনাশী চেতনার নাম শেখ মুজিব।
তিনি বাঙালি জাতির কাছে স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের মহানায়ক, পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির মহান পথপ্রদর্শক, আবহমান বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ। তিনি বাঙালির অসীম সাহসিকতার প্রতীক সমগ্র বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। যে বছর বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম চূড়ান্ত লড়াইয়ের রূপ পেল, সেই ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হল পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের একটি কবিতা।
‘বঙ্গ-বন্ধু’ শিরোনামে সেই কবিতায় তিনি লিখলেন – ‘মুজিবর রহমান / ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উদারী বান।’
জন্মদিন নিয়ে বিশেষ কোনো ভাবনা ছিল না বঙ্গবন্ধুর; তিনি বলতেন, ‘আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু। আমি তো আমার জীবন জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি।’
তার হাত ধরেই বাঙালি পেয়েছিল স্বাধীনতার দিশা; অর্ধশতকের পথচলায় অর্থনৈতিক মুক্তির যে সোনালি দিগন্তের সামনে আজ বাঙালি দাঁড়িয়ে, তারও অনুপ্রেরণা তিনি।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তদানীন্তন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুনের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিব নামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। চার বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়।
পরাধীনতার নিকষ অন্ধকারে নিমজ্জিত বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে মুক্তির প্রভাকর রূপে জন্ম নেওয়া ‘খোকা’ নামের সেই শিশুটি শিক্ষা-দীক্ষা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, মহত্তম জীবনবোধ সততা, সাহস, দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ার চিরায়ত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না আবেগ-অনুভূতি শিশুকাল থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। গ্রামের মাটি আর মানুষ তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতো। শৈশব থেকে তৎকালীন সমাজ জীবনে তিনি জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজা পীড়ন দেখে চরমভাবে ব্যথিত হতেন। গ্রামের হিন্দু, মুসলমানদের সম্মিলিত সম্প্রীতির সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িক চেতনার। কিশোর বয়সেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন।
গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা। তিনি সারাজীবন এদেশের মাটি ও মানুষের অধিকার আদায় ও কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করেছেন। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য জীবনের ১৪ বছর পাকিস্তানি কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্টে বন্দি থেকেছেন, দুই বার ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু আত্মমর্যাদা ও বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কখনো মাথা নত করেননি, পরাভব মানেননি।
১৯৪২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন শেখ মুজিব। তার রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়তে থাকে। কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন ১৯৪৬ সালে। ১৯৪৭ সালে এই কলেজ থেকেই তিনি স্নাতক ডিগ্রি নেন।
ভারত এবং পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৭ সালে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন শেখ মুজিব। এই উদ্যোগ ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে এটাই তার স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি গড়ে দেয়।
দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গঠন করেন। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪- এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২- এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬- এর ছয়-দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ’৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
বঙ্গবন্ধুর সাহসী, দৃঢ়চেতা, আপোষহীন নেতৃত্ব ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়ে জেগে ওঠে শত বছরের নির্যাতিত-নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতি। মুক্তির অদম্য স্পৃহায় উদ্বুদ্ধ করে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন। অতঃপর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ঘোষণার পর দেশজুড়ে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন। স্বাধীন বাংলার মাটিতে জাতির পিতার প্রথম জন্মদিন। তবে সেদিনও বরাবরের মতোই অনাড়ম্বর আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয় বাঙালির মুক্তির দূতের জন্মদিন।
এর কারণ হতে পারে, বঙ্গবন্ধু হয়তো সেটি প্রত্যাশা করেননি বা হতে দেননি। আরও একটি কারণ ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সেদিনই উপস্থিত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানকারী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ফলে দিনটি ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যেই কাটাতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। তবে সেদিন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ৫৫ কোটি ভারতবাসীর পক্ষ থেকে ফলমূল ও মিষ্টান্ন উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আয়োজনকে দিয়েছিলেন ভিন্নমাত্রা।
প্রাণের চেয়েও প্রিয় বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর মাত্র চারটি জন্মদিন পালনের সুযোগ মিলেছিল। এর ঠিক এক বছর আগে ভয়াল একাত্তরের মার্চেই ছিল তার ৫২তম জন্মদিন। সেদিন তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। এর জবাবে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আজ আমার জন্মদিন। তবে ৫৩তম নয়। পত্রিকায় ভুল ছাপা হয়েছে, আজ আমার ৫২তম জন্মদিন’।
তখন একজন বিদেশি সাংবাদিক জন্মদিন পালনের প্রসঙ্গ তুললে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না। এই দুঃখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই বা কী, আর মৃত্যুদিনই বা কী? আপনারা বাংলাদেশের অবস্থা জানেন। এ দেশের জনগণের কাছে জন্মের আজ নেই কোনো মহিমা। যখনই কারও ইচ্ছা হলো আমাদের প্রাণ দিতে হয়। বাংলাদেশের জনগণের জীবনের কোনো নিরাপত্তাই তারা রাখেনি। জনগণ আজ মৃতপ্রায়। আমার আবার জন্মদিন কী? আমার জীবন নিবেদিত আমার জনগণের জন্যে। আমি যে তাদেরই লোক।’
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ‘বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব হউন’ শিরোনামে ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ছাত্র ও সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জাতির পিতার জন্মদিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ বেতার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কয়েকটি বিশেষ অনুষ্ঠানও প্রচার করে। সকাল ১০টায় ‘অন্তরঙ্গ সংলাপ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর বাল্যকাল এবং যৌবনকালের কথামালা প্রচারিত হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্পোরেশন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বিশেষ অনুষ্ঠানাদি প্রচার করে। এর মধ্যে ছিল সন্ধ্যা ৬.৪০ মিনিটে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের অনুষ্ঠান। ৮.৩০ মিনিটে প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতার সাক্ষাৎকার।
একই পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তাজউদ্দীন’ শিরোনামে অপর সংবাদে জানা যায়, ‘‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এক শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, আজ ১৭ মার্চ। মহান বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবের জন্মদিন। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠে আজ একটি মাত্র স্লোগান-জয়তু মুজিব! আর এই স্লোগানের মুহুর্মুহু ধ্বনির প্রতিধ্বনি মহান নেতার জন্মতিথিতে তাহাকে জানাইতেছে স্বাধীন দেশের প্রতিটি নাগরিকের হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধার্ঘ্য, প্রীতি, শুভেচ্ছা, আশীষ, আর ভালোবাসা। কামনা তাহাদের একটিই- মুজিব, তুমি দীর্ঘজীবী হও!’’
স্বাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ জন্মদিন :
দৈনিক ইত্তেফাকের ১৯৭৫ সালের ১৮ মার্চ সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ৫৫তম জন্মজয়ন্তী নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘বঙ্গবন্ধুর ৫৫তম জন্মজয়ন্তী: নেতার স্বপ্ন সফল করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা’ শীর্ষক সংবাদ থেকে জানা যায়, “গতকাল (সোমবার) ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৫তম জন্মবার্ষিকী। সমগ্র জাতি গভীর শ্রদ্ধার সহিত এই দিনটি পালন করে। এই দিন সরকারি ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং দেশের বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, গীর্জায় বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হয়।
বাকশাল, জাতীয় শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ মহিলা সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল প্রভৃতির আয়োজন করা হয়। নেতার জন্মদিনে আয়োজিত বিভিন্ন আলোচনাসভায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাইবার জন্য কর্মদ্যোগী হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলির পক্ষ হইতেও বঙ্গবন্ধুকে মাল্যভূষিত করা হয়।
জন্মদিনে নেতাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য তাহার বাসভবন অভিমুখে ছিল জনতার স্রোত। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কমপক্ষে ৫০ হাজার লোকের সমাগম হয়। নেতা ও জনতার সম্মিলনে কোন বাধা ছিল না। ভোর সাড়ে ছয়টা হইতে ৩২নং রোডস্থ বাসভবনে নেতার সাক্ষাৎ প্রার্থীদের ভিড় শুরু হয়। কেহ ফুলের মালা, পুষ্পস্তবক, কেহবা জন্মদিনের কেক, মিষ্টিসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী লইয়া জাতির জনকের বাসভবনে উপস্থিত হন, শুভেচ্ছা জানান, মঙ্গল কামনা করেন। বঙ্গবন্ধু প্রফুল্লচিত্তে আগতদের সকলকেই সাক্ষাৎদান করেন ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সকাল ৭টা হইতে সোয়া ১১টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টাধিককাল ধরিয়া তিনি শুভার্থীদের সাক্ষাৎদান করেন। বাকশাল, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংস্থা আসিয়াছিল মিছিল সহকারে, দলবদ্ধভাবে।
বঙ্গবন্ধু পুষ্পমাল্যগুলি পাঠাইয়া দেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা, মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ভাষা আন্দোলনের শহীদানের মাজারে, শহীদ মিনারে এবং সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে। বঙ্গবন্ধু আগত সকলকেই দেশ গঠনে কঠোর পরিশ্রম করার উপদেশ দেন।
সকাল ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু সমবেত সকলের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার জন্মদিনে আমি ছুটি ঘোষণা করি নাই। তাই আজ আমি অফিসে যাইব, অল্পক্ষণের জন্য হইলেও অফিসের কাজ করিব।’ উপস্থিত সকলকে তিনি নিজ নিজ অফিসে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সকাল প্রায় সোয়া ১১টার সময় বঙ্গবন্ধু গণভবনের উদ্দেশ্যে বাসভবন ত্যাগ করেন।”
বিংশ শতাব্দীতে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে যারা বিশ্বনন্দিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের অন্যতম।
সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরামহীন সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য তিনি বিশ্বশান্তি পরিষদের ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত হন।
বিবিসি’র এক জরিপে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন। বিশ্ব গণমাধ্যমের চোখে বঙ্গবন্ধু ক্ষণজন্মা পুরুষ। অনন্য সাধারণ এই নেতাকে ‘স্বাধীনতার প্রতীক’ বা ‘রাজনীতির ছন্দকার’ খেতাবেও আখ্যা দেওয়া হয়। বিদেশি ভক্ত, কট্টর সমালোচক এমনকি শত্রুরাও তাদের নিজ নিজ ভাষায় তার উচ্চকিত প্রশংসা করেন।
খায়রুল আলম ।। সাংবাদিক; যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন