রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : অস্থিতিশীলতা, পরিপ্রেক্ষিত এবং বাস্তবতা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অনুভূত হতে শুরু করেছে। যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার আশঙ্ক্ষা থেকে নিত্য-নতুন পর্যালোচনা প্রকাশিত হচ্ছে এবং অনেক বিশ্লেষক আশঙ্ক্ষা করছেন রাশিয়া এই যুদ্ধে জয় পেলে অন্যান্য দেশও সীমান্তে একইরকম কৌশল অবলম্বন করতে পারে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলো নিয়ে নতুন করে ভূ-রাজনৈতিক ছক কষা শুরু হয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্য এই ছক কষার বাইরে নয়।
করোনা মহামারি এবং চীন-মার্কিন সম্পর্কের সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ববাসীর জন্য একটি বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তা কোনো সমীকরণ মেনে চলে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের গণ্ডি পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের সূচনা করতে পারে এমন আশঙ্ক্ষা অনেক বিশ্লেষকের।
বিজ্ঞাপন
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ফলাফল হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ইউরোপে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে হয়ে উঠতে পারে তৎপর। এদের মধ্যে ইসরায়েল ও ইরান অন্যতম।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ইরাক, আফগানিস্তান এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত শব্দ। একই শব্দদ্বয় এখন ব্যবহার করছে রাশিয়া। এই শব্দদ্বয় ব্যবহার করে যদি ইসরায়েল বা ইরান মধ্যপ্রাচ্যে কোনো পদক্ষেপ নিতে চায় তবেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে চলমান বাস্তবতায় ৫টি সম্ভাব্য চিত্রকল্প পরীক্ষা করে দেখছেন। ভূ-রাজনীতি এবং যুদ্ধ এমনই একটি বিষয় যার ভবিষ্যৎ পূর্বানুমান করা কঠিন। তবে সম্ভাব্য কিছু চিত্র এখানে আলোচনা করা হলো-
প্রথমত, গত কয়েক মাসে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে বড় ধরনের কোনো সংঘাত হয়নি। তবে দু’পক্ষের মধ্যেই চাপা ক্ষোভ বিদ্যমান এবং যেকোনো সময় উত্তেজনা চরমে উঠতে পারে। অবস্থা এরকম যে, ‘সব ইউরেনিয়াম রাখা আছে, শুধু ট্রিগার চাপার অপেক্ষা।’
রাশিয়ার মতো ইসরায়েলও যেকোনো সময় আঞ্চলিক নিরাপত্তার অজুহাতে ফিলিস্তিনের নতুন নতুন এলাকার দখল নিতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ততার সুযোগে ইসরায়েল নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে যেকোনো মুহূর্তে হয়ে উঠতে পারে তৎপর যা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্থিতিশীলতা ডেকে আনবে।
দ্বিতীয়ত, ইউরোপে অনেকটা একঘরে হয়ে পড়া পুতিন চীন ও ইরানকে কেন্দ্র করে পরবর্তী রাজনৈতিক চাল খেলতে চাইবেন। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে চীন আপাতত নীরব। অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধ সামলাতে অনেকটা এশিয়ামুখী পুতিন। রাশিয়া, চীনে জ্বালানি সরবরাহ করে অবরোধের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগ্রহী।
সম্প্রতি চীনে রাশিয়ার কয়লা ও গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে। অন্যদিকে বিপদে পড়েছে ইউরোপ। দফায় দফায় বাড়ছে তেল ও গ্যাসের দাম। আবার, বিশ্বের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের কাছে অস্ত্রের চোরাচালানও বৃদ্ধি করেছে রাশিয়া। যা যুদ্ধ পরিস্থিতিতিতে কিছুটা অর্থনৈতিক স্বস্তি জোগাবে দেশটিকে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মূলত ছদ্মাবরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া যুদ্ধ। রাশিয়া সোভিয়েত পূর্ব সাম্রাজ্য ফিরে পেতে চায় অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় বিশ্বে নিজস্ব সম্মান ও প্রভাব বজায় রাখতে। তাই, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে বলা যায় নতুন ঠাণ্ডা যুদ্ধের (New Cold War) সূচনা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বহুমুখী চাপে ফেলতে মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে ইরান কার্ড হাতে নিতে পারে রাশিয়া। ইরান সংকট আলোচনায় রাশিয়া বরাবরই একটি বড় শক্তি এবং ইউক্রেন আক্রমণের ফলে পশ্চিমা বিশ্ব যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তার জবাব দিতে ইরানকে ব্যবহার করতে আগ্রহী পুতিন।
পশ্চিমাদের দৃষ্টি অন্য দিকে সরাতে রাশিয়া ইরানের পারমাণবিক শক্তি সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিতে নতুন করে সহায়তা শুরু করতে পারে যা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য প্রভাবশালী শক্তি ইসরায়েলের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ইরানের নতুন করে পারমাণবিক শক্তি সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিতে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।
তৃতীয়ত, রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে ইরান জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন কোন অঞ্চল বা দেশ বিশেষত, বাহরাইন আক্রমণ করতে পারে যেখানে মোতায়েন রয়েছে মার্কিন নৌবাহিনীর পঞ্চম নৌবহর। ইরানের উদ্দেশ্য থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিরক্ত করা।
ইরান ইতিমধ্যে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সংযুক্ত আরব আমিরাতে ড্রোন হামলায় ইন্ধন জুগিয়েছে। অন্যদিকে, ইরান ইরাকি মিলিশিয়াদের সৌদিআরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে হামলায় মদদ দিয়েছে। ফলে, ইউরোপ জুড়ে অস্থিরতার সুযোগে ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনার টেবিলে আনতে পারস্য উপসাগরে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে যেখানে সে দরকষাকষির সুযোগ পাবে। অন্যদিকে, সিরিয়ার তানফে মার্কিন ঘাঁটিতে বা ইব্রিলে মোতায়েনকৃত মার্কিন বাহিনীর উপর হামলারও পরিকল্পিত সমীকরণ বেছে নিতে পারে ইরান। যদিও এই সম্ভাবনাগুলো কম।
চতুর্থত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অন্য একটি সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে, সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধের নতুন সমীকরণ। রাশিয়া ইউক্রেনের উপর থেকে বিশ্বের নজর সরাতে সিরিয়ায় নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে আগ্রহী। সিরিয়ায় রাশিয়ার সক্রিয় উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য অস্বস্তির কারণ। ‘Washington Institute for Near East Policy’-এর বিশেষজ্ঞ আনা বরশেচেভস্কায়া (Anna Borshchevskaya) বলেন, 'রাশিয়া অনেক হিসাব কষেই ২০১৫ হতে প্রায় ৭ বছর সিরিয়ায় অবস্থান করছে, যেখানে তার নৌ ও বিমান ঘাঁটি রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে কোণঠাসা করার প্রচেষ্টা নিতে পারে রাশিয়া নিজেই।’
এছাড়া, ইতিমধ্যে ইউক্রেন থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নিয়ে বিপদে ইউরোপ। মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করার মাধ্যমে নতুন করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে উদ্বাস্তুদের স্রোত ইউরোপের দিকে ঠেলে দিতে পারেন পুতিন। ফলে চতুর্দিক থেকে ইউরোপকে উদ্বাস্তুদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হবে। আবার ইউরোপে ন্যাটো জোটের শক্তি বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব-সিরিয়ার ঘাঁটি কিংবা তানফ ঘাঁটি গুটিয়ে নিতে আগ্রহী।
অন্যদিকে, রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে আপাতত সিরিয়া ত্যাগ করাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে, সিরিয়া নিয়ে দোটানায় পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সুযোগে মঞ্চে হাজির তুরস্ক। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে তুরস্ক চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারসাম্য বজায় চলেছে।
তুরস্ক একদিকে ইউক্রেনকে ড্রোন সরবরাহ করছে অন্যদিকে রাশিয়া থেকে এস-৪০০ মিসাইল কিনছে। চলমান অস্থিরতার সুযোগে তুরস্কের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়কেই ব্ল্যাকমেইল করার সুযোগ রয়েছে। তুরস্ক রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধির কথা বলে প্রয়োজনীয় সুবিধা আদায় করে নিতে পারে অন্যদিকে ন্যাটো বাহিনীকে সহায়তার কথা বলে সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় নতুন করে হামলা শুরু করতে পারে। এমনকি এই সুযোগে তুরস্ক ইরাকের সিনজার ও মাখমুর অঞ্চলের ইয়াজিদি ও কুর্দিদের উপরও আক্রমণ চালাতে পারে যা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সংঘাতের জন্ম দেবে।
পঞ্চমত, যুদ্ধের পরোক্ষ ফলাফল হিসেবে, হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের সরাসরি যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। লেবাননের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন ভঙ্গুর। এছাড়া লেবানন গমের জন্য ইউক্রেনের উপর নির্ভরশীল। যুদ্ধের কারণে লেবাননে গমের সংকট দেখা দিবে। এই সুযোগে হিজবুল্লাহ গোলান মালভূমি ও লেবাননের সীমান্তে কার্যক্রম জোরদার করতে পারে। আবার, ইরানের প্রত্যক্ষ মদদে হুতি, হামাস, ইরাকি ও সিরিয়ার মিলিশিয়ারা ইসরায়েলের সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
যে সম্ভাবনাগুলোর কথা বলা হলো, এগুলো যে হুবহু এরকমই ঘটবে তা নাও হতে পারে। হয়তো এগুলোর কোনো একটি বা দুটি মিলে ভিন্ন কোনো পরিণতিও ডেকে আনতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধে আগামীতে যা-ই ঘটুক আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সমীকরণ পাল্টে গেছে। তা আর পূর্বাবস্থায় ফেরত যাবে না। আর বিশ্বজুড়ে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা কাম্য নয়।
এ. কে. এম ইফতেখারুল ইসলাম ।। সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য