বাংলাদেশের নারী ও ইউক্রেনের নারী
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুরনো ঢাকার সংখ্যালঘু এলাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মতো বিশেষ এলাকাসহ গোটা ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’র আওতায় যে হত্যাযজ্ঞ ২৫ মার্চ রাতে শুরু হয়, তা চলে পরবর্তী নয় মাস অবধি যাতে ত্রিশ লক্ষ মানুষ নিহত, এক কোটি মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে শরণার্থী হওয়া ছাড়াও দুই থেকে চার লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন। তবে, অনেক হিসাবেই দেখা যাচ্ছে যে, সরকারি যে দুই লক্ষ থেকে চার লক্ষ ধর্ষিতা নারীর কথা বলা হয়, প্রকৃত ধর্ষিতার সংখ্যা তার থেকেও বেশি হওয়া অসম্ভব নয়।
সুসান ব্রাউনমিলার (Susan Brownmiller)-এর ‘অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন, ওমেন অ্যান্ড রেপ [Against Our Will: Men, Women and Rape, 1975]’ গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষে ৪ লক্ষ গর্ভপাত সংঘটিত হয়েছিল (পৃষ্ঠা-৮১)। তাহলে ধর্ষিতার সংখ্যা চার লক্ষের চেয়েও বেশি হওয়ার কথা। যেহেতু, এক লক্ষ ধর্ষিতা নারীকে ধর্ষণের পর পাক বাহিনী হত্যা করেছিল (Mass Rape and the Inscription of Gendered and Racial Domination during the Bangladesh War of 1971, নয়নিকা মুখার্জি, ২০১২)।
বিজ্ঞাপন
অস্ট্রেলীয় ডাক্তার জিওফ্রে ডেভিস (Geoffrey Davis) তার ‘দ্য চেঞ্জিং ফেস অব জেনোসাইড’- এ লিখেছেন, ‘যুদ্ধের সেই সময়ে গড়ে প্রতিদিন প্রতিটি থানা বা পুলিশ স্টেশন থেকে দিনে দু’জন করে তরুণী নিখোঁজ হয়ে যেত। সারাদেশে মোট ৪৮০টি থানা ছিল এবং পাকবাহিনী এদেশে অবস্থান করেছে মোট ২৭০ দিন। এভাবে, গোটা সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছিল ২ লক্ষ ৬৮,০০০।’
যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই জিওফ্রে ডেভিস ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (হু)’-র অনুরোধে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুদ্ধে ধর্ষিতা মেয়েদের নিরাপদ গর্ভপাত ও অন্যান্য স্বাস্থ্যগত বিষয়ে সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে, সেই সময় তিনি সারাদেশে মোট ৩,৬০,০০০ ধর্ষিতা নারীকে পেয়েছিলেন (Picking up the Pieces: 1971 War Babies’ Odyssey from Bangladesh to Canada. 2015. Mustafa Chowdhury)।
ডাক্তার জিওফ্রে ডেভিস উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় অল্প কিছু নমুনা জরিপ চালিয়ে সবশেষে স্থির করেছিলেন যে, ন্যূনতম পক্ষে চার লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ ত্রিশ হাজার নারী মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিতা হন (1971 Rapes: Bangladesh Cannot Hide History. 2012. Anushay Hossain; Women’s Media Centre Conflict Profile: Bangladesh. 2012. Michele Lent Hirsch)।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই জিওফ্রে ডেভিস ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (হু)’-র অনুরোধে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুদ্ধে ধর্ষিতা মেয়েদের নিরাপদ গর্ভপাত ও অন্যান্য স্বাস্থ্যগত বিষয়ে সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে, সেই সময় তিনি সারাদেশে মোট ৩,৬০,০০০ ধর্ষিতা নারীকে পেয়েছিলেন...
যদিও পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী বাঙালি রাজাকারদের মূল লক্ষ্য ছিল সংখ্যালঘু নারী এবং সেইসাথে ‘মুসলিম’ হিসেবেও ‘পুরোপুরি বিশুদ্ধ নয়’ এবং ‘শ্যাম বর্ণ, খর্বকায়’ বাঙালিদের ‘গৌর বর্ণ ও দীর্ঘকায়, বিশুদ্ধ, পাঞ্জাবি মুসলিম সৈন্য’ দ্বারা গর্ভবতী করে বাঙালি জাতির ‘জাতিগত শুদ্ধিকরণ’ সম্পূর্ণ করা, তবু জনসংখ্যার আনুপাতিক হিসেবে নয় মাস শেষে দেখা যাচ্ছে যে চার লক্ষ ধর্ষিতা নারীর ভেতরে আশি ভাগ নারীই ছিল মুসলিম (অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন, ওমেন অ্যান্ড রেপ (১৯৭৫, পৃষ্ঠা-৮১)।
যেহেতু জনসংখ্যার হিসাবে তখন বাঙালি মুসলিম ছিল শতকরা ৭৫-৭৮ ভাগ এবং প্রায় এক কোটি সংখ্যালঘু নাগরিক দেশছাড়া হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ড. এম.এ. হাসানের গবেষণা গ্রন্থ ‘How Black Chapter of History: Torture of the Women of Ekattar’-এ তিনি নিজেই তার করা এক গবেষণা কর্মের উল্লেখ করে বলেন যে, দেশের মোট ৪২টি জেলার ২৫৭ জন নাগরিকের সাথে ২৫টি ইন্টারভিউয়ের প্রেক্ষিতে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ১৯৭১ সালে ২০২,০০০ নারী ধর্ষিতা হয়েছে।
সারাদেশে ধর্ষিতা ও নিগৃহীতা মিলিয়ে মোট সংখ্যাটি দাঁড়াবে ৪৫০,০০০-এর উপর (How many women were abused in the Liberation War? Hasan Hamid, BD News Opinion, October 15 of 2018)।
বাংলার নারীর এই রক্ত ও অশ্রুগাথার সাথে তুলনা করলে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধে রুশ সৈন্যদের কর্তৃক সামাজিক গণমাধ্যমে (টিন্ডারে) ইউক্রেনীয় মেয়েদের উদ্দেশ্যে গণহারে প্রেম নিবেদন ছাড়া এখনো কোনো নারী নিগ্রহের খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে আসেনি।
তাতেই অবশ্য ইউক্রেনীয় নারীরা ভয়ে অনেকেই টিন্ডারে তাদের ঠিকানা বদল করছেন বলে সংবাদমাধ্যম বলছে। যদিও ইউক্রেনের ‘বড় প্রতিবেশী’ রাশিয়ার বিরুদ্ধে জার শাসনামলের সময় থেকে কমিউনিস্ট, সোভিয়েত আমলেও ইউক্রেনের উপরে রুশ ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে, তবে তারপরও তারা দীর্ঘদিনের প্রতিবেশীও বটে।
বাংলা ও হিন্দির মতো রুশ ও ইউক্রেনীয় ভাষায় বেশ খানিকটা মিলও আছে বলে ইউক্রেনের শিক্ষায়তনে রুশ ভাষায় উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করেছেন এমন কোনো কোনো বাঙালির কাছ থেকে শুনেছি। রুশ ও ইউক্রেনীয় জনগোষ্ঠী উভয়েই অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী এবং বর্ণে শ্বেত।
বাংলার নারীর এই রক্ত ও অশ্রুগাথার সাথে তুলনা করলে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধে রুশ সৈন্যদের কর্তৃক সামাজিক গণমাধ্যমে (টিন্ডারে) ইউক্রেনীয় মেয়েদের উদ্দেশ্যে গণহারে প্রেম নিবেদন ছাড়া এখনো কোনো নারী নিগ্রহের খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে আসেনি।
রুশরা তাই ঠিক পাকবাহিনীর মতো ‘খর্বকায়, শ্যাম বর্ণ, বিধর্মী’ ইউক্রেনীয়দের মাঝে ‘যুদ্ধ শিশু’ জন্ম দেওয়ার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে মনে হয় না।
বরং ২৫ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি-তে প্রচারিত একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও ক্লিপে দেখা যাচ্ছে, রাশিয়া কর্তৃক ২০১৪সালে দখলকৃত ইউক্রেনের ক্রিমিয়ার মাত্র আঠারো মাইল দূরবর্তী হেনিচেস্ক নামের এক বন্দর নগরীতে এক সাহসী নারী রাস্তায় টহলরত রুশ সৈন্যদের ‘তোমরা কারা? দখলদার- ফ্যাসিস্ট’ বলে তর্ক করলেও রুশ সৈন্যরা তাকে বলেন, ‘আমরা এখানে অনুশীলন করছি। দয়া করে ওপথ দিয়ে চলে যান।’
উত্তরে সাহসিকা একটুও না দমে বরং বলেন, ‘তোমরা আমাদের দেশে কী করছ?’ সৈন্যরা এরপরও তাদের বড় বড় মেশিনগান ও হ্যান্ডগান হাতেই নারীটিকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলেন, ‘আমাদের আলোচনায় কিছু আসবে যাবে না।’
উত্তরে নারীটি আবার বলেন, ‘আমাদের মাটিতে বন্দুক হাতে তোমাদের কী কাজ? বরং পকেটে করে কিছু সূর্যমুখী ফুলের বীজ নিয়ে যাও। তোমরা যখন আমাদের মাটিতে লম্বা হয়ে শোবে, তখন এই বীজ পুঁতলে সূর্যমুখী ফুলের গাছগুলো তোমাদের ছায়া দেবে।’
পাশে চলাচলরত পথচারীরা এই কথোপকথন সাথে সাথে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন, যা সারা পৃথিবীতেই লাখ লাখ নেটিজেনের প্রশংসা কুড়ায়।
উল্লেখ্য, সূর্যমুখী ইউক্রেনের জাতীয় ফুল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে সোফিয়া লোরেন অভিনীত অনবদ্য সিনেমা ‘সানফ্লাওয়ার’ (১৯৭৫)-এর শুরু ও শেষে দিগন্তপ্রসারী সূর্যমুখী ক্ষেতের দৃশ্য এই সংবাদ পাঠের পর অনেকেরই মনে পড়বে।
সত্যি কথা বলতে, যুদ্ধে রাষ্ট্রনায়ক ও সমরনায়কদের বীরত্বের ক্ষয়-খতিয়ানের চেয়ে অতি সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের আনন্দ-বেদনার নানা গল্পই মানুষ প্রজন্মান্তরে মনে রাখে। যেমন বলতেই হয়, ইউক্রেনের ইয়ারিনা আরিভা ও ভিয়াতোস্লাভ ফারসনের কথা।
অতি তরুণ এই যুগল বিয়ের জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু যুদ্ধ শুরু না হতেই এই বীর দম্পতি পাদ্রির কাছে ছুটে গিয়ে, ঐতিহ্যবাহী ইউক্রেনীয় পোশাকে বিয়ে সেরেই হাতে রাইফেল তুলে নিয়েছেন। বর-কনে দু’জনের হাতেই রাইফেল। রণসজ্জাই আজ তাদের মধুচন্দ্রিমার দিন-রাত্রি।
বাংলাদেশেও বীরপ্রতীক তারামন বিবি, কাঁকন বিবি বা আশালতা বৈদ্যদের মতো সশস্ত্র যুদ্ধে অনেক নারী অংশ নিয়েছেন- যুদ্ধে নিগৃহীতা হওয়ার পাশাপাশি।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ অচিরেই থেমে যাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের তাঁবেদার ন্যাটো তথা পশ্চিমাদের কূট চালে উত্তেজিত পুতিনের ভুলে পৃথিবী তৃতীয় মহাযুদ্ধের মুখোমুখি না হোক। আর প্রতিটি যুদ্ধেই নারীর প্রান্তিকীকরণের তো শেষ নেই।
বাংলার নারী হিসেবে আজ তাই বিশ্ব নারী দিবসে ইউক্রেনীয় নারীদের জন্য উদ্বিগ্ন বোধ করছি। ‘যুদ্ধের নারীকরণ’ বা ‘ফেমিনাইজেশন অফ ওয়ার’ বন্ধ হোক। এখুনি।
অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক