ছবি : সংগৃহীত

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে পথ চলতে শুরু করে দিনে দিনে পরিণত ও স্পট হয়েছিল বাঙালির মুক্তির পথ। মুক্তির মহানায়ক হয়ে যিনি উঁচু-নিচু বন্ধুর পথ পেরিয়ে বাঙালি জাতিকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসেন সদর্পে, তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত দিক নির্দেশনা দিতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের সমাবেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।

সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে রয়েছে হাজারো গবেষণা আলোচনা-পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ। এই ভাষণ বাঙালি জাতির ওপর কী প্রভাব ফেলেছে বা মানুষ কীভাবে দ্রুত স্বাধীনতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে গেছে, এ ভাষণের অনুপ্রেরণা বাঙালি জাতিকে কীভাবে চূড়ান্ত স্বাধীনতা এনে দিয়েছে সেটি আজ আলোচনার প্রতিপাদ্য। একই সাথে এই মর্ম অনুভূতি নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছানো আমাদের অনিবার্য দায়িত্ব।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতির নেতৃত্বকে দাবিয়ে রাখার জন্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করলেন। ঢাকা ও সারাদেশে জনগণ ইয়াহিয়া খানের এ অগণতান্ত্রিক ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ মানুষ স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নেমে পড়ে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হন।

বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় হরতাল, ৩ মার্চ সারাদেশে ও ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। জনতার প্রতিবাদ, বিক্ষোভ মিছিল প্রতিহত করার জন্যই সামরিক সরকার ২ মার্চ থেকে সান্ধ্য আইন জারি করে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা কারফিউ অগ্রাহ্য করে শহরে প্রতিবাদ মিছিল বের করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শান্তিপূর্ণ ও শৃঙ্খলার সঙ্গে হরতাল পালন এবং লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির মতো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের মূল ভাষণটি ২৩ মিনিটের হলেও ১৮-১৯ মিনিট রেকর্ড করা হয়েছিল। এ ভাষণে সব থেকে বড় অবদান বঙ্গমাতার। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘অনেকে অনেক কিছু বলে, লিখে দিয়েছে, একমাত্র তুমিই জানো কী বলতে হবে! তোমার মনে ঠিক যে কথাগুলো আসবে, তুমি তা-ই বলবে।’

বঙ্গবন্ধু কথা শুনে হাসলেন, তারপর মাঠের দিকে রওনা হলেন। তার দীর্ঘ ৩০ বছরের রাজনীতির আলোকে নিজের চিন্তা থেকে তিনি ৭ মার্চের ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ নিয়ে অনেক বিশ্বনেতা, অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ওই সময়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছে।

১৯৭১ সালের ওই সময়ই বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির ভাষ্য ছিল, ‘৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওইদিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে আরেকটি নতুন দিকের সূচনা ঘটেছিল। দেশ পরিচালনার ভার সামগ্রিক বিবেচনায় তখন বঙ্গবন্ধুর হাতে। কেন্দ্রীয় সরকারের দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণ কোথাও ছিলনা। এদিনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষিত কর্মসূচির একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ওই কর্মসূচি ঘোষণার ফলে প্রতীয়মান হয়, বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলায় এক সমান্তরাল সরকার পরিচালনা করেন।

৮ মার্চ থেকেই রেডিও, টেলিভিশন, দেশের সমুদয় প্রশাসন ও জীবনযাত্রা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুসরণে চলতে থাকে। এদিন কেবল সেনানিবাস ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি। সর্বত্রই ছিল সবুজ জমিনে লাল সূর্য, মাঝে সোনালি রঙের ভূ-মানচিত্র আঁকা বাংলাদেশের পতাকা।

ঢাকা শহর থেকে গ্রামে-গঞ্জে, মহল্লায় নানাভাবে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয় কাঠের রাইফেল অথবা লাঠিসোটা নিয়ে। এদিন থেকে কার্যত দেশ স্বাধীনরূপ নেয়। ৭ই মার্চের ভাষণের সাথে প্রতিবাদের ঝড় উঠে সকল মহলে। সামরিক শাসন, নির্যাতন-অত্যাচার, অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তার ‘হেলাল-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব, দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামছুদ্দীন ও ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী পাকিস্তান খেতাব বর্জন করেন।

বাংলাদেশে ১৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল টান টান উত্তেজনাপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে হেয়ার রোডে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট ভবনে আলোচনার জন্য যান। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার ডিউটিতে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা বঙ্গবন্ধুকে আসা-যাওয়ার সময় রাষ্ট্রনায়কের মতোই সশ্রদ্ধ অভিবাদন সালাম ও গার্ড অব অনার প্রদান করতেন।

পুলিশ সদস্যরা গার্ড অব অনার বা অভিবাদন সালাম প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে তাদের দেশপ্রেম ও মুক্তি কামনার অব্যক্ত বারতা পৌঁছে দিয়েছেন। প্রস্তুতিকালীন সময়ের অসহযোগ আন্দোলনের সেই দিনগুলোয় প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৩২ নম্বর বাসভবনে সর্বস্তরের মানুষের বাঁধভাঙা ঢল নামত। মনে হতো যেন স্বাধীনতার সব রাজপথ এসে যেন ৩২ নম্বরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি পুলিশের চোখেমুখে মুক্তির জন্য উন্মুখ এক তেজোদ্দীপ্ত চাহনি দেখে বাঙালি ছাত্র শিক্ষক শ্রমিক কৃষক সকলের মাঝে সাহস সঞ্চারিত হতে থাকে। রাজারবাগের পুলিশ সদস্যদের ভেতরে ভেতরে আগাম প্রস্তুতি পরিলক্ষিত হয়েছিল।

২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনার অজুহাতে ২৫ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করেন। জনসাধারণ সেদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিটি ঘরের ছাদে কালো পতাকার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা নতুন পতাকাটিও ওড়ায়। সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বিদেশি দূতাবাস, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সর্বত্রই উত্তোলন করা হয় এ পতাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসভবনেও স্বাধীন বাংলার পতাকা পতপত করে উড়ছিল।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই একমাত্র ভাষণ যার মধ্য দিয়ে গোটা বাঙালি জাতি সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সন্দেহ-অবিশ্বাস ঝেড়ে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই হচ্ছে বিশ্বসেরা ভাষণ। এর আগে মানুষের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কারণ সংসদ অধিবেশন বসার প্রস্তুতি চলছে প্রথমে ৩ মার্চ, পরে ২৫ মার্চ। অন্যদিকে আবার নানা ধরনের সমঝোতা বৈঠক চলছে।

বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতির বঞ্চনার কথা বলেছেন, রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা বলেছেন, বাঙালির মুক্তির সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির কথা বলেছেন, সর্বোপরি স্বাধীনতার কথা বলেছেন,

‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল,

প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।

তোমাদের যা কিছু আছে,

তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে...

মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো।

এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব...

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি শব্দই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৭ মার্চ এবং ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক গুরুত্ব।

বাঙালি জাতি যেন যুগ যুগ ধরে এ ভাষণের জন্য অপেক্ষা করেছে তাদের মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য। ইতিমধ্যে স্বাধীনতা ঘিরে অনেক সরকারি-বেসরকারি দিবস পালিত হয়। কিন্তু ৭ মার্চ সেভাবে কোনো দিবস হিসেবে পালিত হয় না।

ইতিহাসের প্রয়োজনে, নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস প্রবাহিত করার জন্য ৭ মার্চকে সরকারিভাবে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন জরুরি। এ যাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে এবছর থেকে ৭ই মার্চ নতুন আঙ্গিকে পালনের সিদ্ধান্ত আগামী প্রজন্মের মধ্যে জাতিসত্তা ও আত্মবিশ্বাস বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে।

মো. সফিকুল ইসলাম ।। অফিসার ইনচার্জ, জেলা গোয়েন্দা শাখা, ময়মনসিংহ