সাতই মার্চ ভাষণ শুধু নয়, স্বাধীনতার রণকৌশলও
এক.
সাতই মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১ সালের এই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল সমাবেশে ভাষণ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পথ রচনা করেছিলেন। তার এই ভাষণ জাতিকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রাণিত করে।
বিজ্ঞাপন
ঐতিহাসিক সাতই মার্চের সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েছে ফেলে আসা ২০২১ সালে, সেই ভাষণ আজও উদ্দীপ্ত করে। মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণে কী ছিল না? নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র করে তোলার জন্য যা যা উপাদান থাকা দরকার, সবই ছিল। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম পুরোধা কমরেড মণি সিংহের ভাষায়—‘এই ঘোষণা ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা। এই ঘোষণা উপস্থিত জনতা ও দেশবাসীকে উদ্দীপ্ত অনুপ্রাণিত করে সীমাহীনভাবে’ (জীবের সংগ্রাম)। আবার বিএনপি নেতা মেজর জিয়াউর রহমান তার ‘একটি জাতির জন্ম’ লেখায় লিখেছেন—‘৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো।’
যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ বলেছেন—‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরূক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’
‘নিউজউইক’ সাময়িকীর বিখ্যাত রিপোর্ট, যেখানে বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ হিসেবে, ‘৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয় একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান।’
১৯৯৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, ‘শেখ মুজিব ৭ মার্চেও ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন’। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের ১৯৭১-এর এক ভাষ্যে বলা হয়—‘শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।’
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে ইউনেসকো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাষণটি ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে যেসব তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ তালিকা প্রণয়ন করে ইউনেসকো। ইউনেসকো প্রথম কোনো ভাষণকে স্বীকৃতি দিল, যেটি একদমই অলিখিত।
জেকোভ এফ ফিল্ডের গ্রন্থে প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নেতা, রাষ্ট্রনায়ক ও মিলিটারি জেনারেলদের উদ্দীপনামূলক বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়েছে। তার দৃষ্টিতে সেরা ৪০টি ভাষণ এতে সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থের শিরোনাম নির্বাচন করেছেন ‘We Shall Fight on the Beaches: The Speeches that Inspired History’। এর অর্ধেক জুড়ে আছে উইনস্টন চার্চিল-এর বিখ্যাত ভাষণ, বাকিটায় স্থান পেয়েছে অন্যান্য শ্রেষ্ঠ ভাষণ।
অনেক ভাষায় বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ অনূদিত হয়েছে। গবেষণা হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সর্বজনীনতা এবং মানবিকতা। যেকোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য এই ভাষণ সবসময়ই আবেদন সৃষ্টিকারী। এই ভাষণে গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার, মানবতা এবং সব মানুষের কথা বলা হয়েছে। ফলে এই ভাষণ দেশ-কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বজনীন হয়েছে। আর একজন মানুষ একটি অলিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন, যেখানে স্বল্প সময়ে কোনো পুনরুক্তি ছাড়াই একটি জাতির স্বপ্ন, সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা বাতলে দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাসের জায়গা থেকে কথা বলেছেন। সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ভাষায় কথা বলেছেন।
সবচেয়ে বড় কথা, বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া বুঝতে পেরেছেন। তারা যা চেয়েছেন, বঙ্গবন্ধু তা-ই তাদের কাছে তুলে ধরেছেন। ফলে এই ভাষণটি একটি জাতির প্রত্যাশার আয়নায় পরিণত হয়। এই ভাষণই একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও এই ভাষণ প্রেরণা জুগিয়েছে। আর এতবছর পরও মানুষ তার ভাষণ তন্ময় হয়ে শোনেন।
দুই.
সাতই মার্চ এসেছিল এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে। পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের ইতিহাস ছিল শোষণ-বঞ্চনার। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কৃত্রিম রাষ্ট্রটি শুরু থেকেই ছিল বাঙালি বৈরী। বাঙালি তার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে গেছে অব্যাহতভাবে।
এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পরই এটা স্পষ্ট হচ্ছিল যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তারা নানা কৌশলে কালক্ষেপণ করছিল আর বাঙালির বিরুদ্ধে হামলে পড়ার জন্য সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। বঙ্গবন্ধু এসব জানতেন। তাই ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়েছেন।
পৃথিবীর সেরা রাজনৈতিক ভাষণের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ব্যতিক্রমী এবং অনন্য। অন্য সব সেরা ভাষণ ছিল লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি লিখিত ছিল না। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মনের কথা জনতার উদ্দেশ্যে বলেছেন। প্রায় ১৯ মিনিটের ভাষণ শেখ মুজিব শুরু করেছিলেন জনতাকে ‘আপনি’ সম্বোধনের মাধ্যমে। বলেছিলেন ‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন’। তিনি জনগণকে তার সহযাত্রী মনে করেছিলেন। যে সহযাত্রীর সব কিছু সম্পর্কেই ‘জানেন এবং বোঝেন’। উভয়ের দুঃখ-বেদনা আশা-আকাঙ্ক্ষা এক। কেউ কারও চেয়ে কম জানে না বা বোঝে না।
প্রকৃত নেতা কখনো তার কর্মী-সমর্থকদের ‘কম বুদ্ধিমান’ মনে করেন না। যেমন করেননি বঙ্গবন্ধু। তিনি শুধু বাস্তবতার দিকগুলো তুলে ধরেছেন। সাধারণ মানুষের অনুভূতিগুলোকে নিজের অনুভূতির সঙ্গে ঝালিয়ে নিয়েছেন। একপর্যায়ে উপস্থিত জনতার সঙ্গে এতোটাই একাত্ম হয়ে পড়েছেন, কখন যে জনতা ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে পরিণত হয়ে গেছে তা না-বক্তা, না-শ্রোতা কেউই খেয়াল করেননি। ভাষণের একপর্যায়ে তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
এই বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান একটি গেরিলাযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। ভাষণ শেষে স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগানমুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাস্তাগুলো। তিনি বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব...’
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তিনি পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি। তার এই কৌশলের কারণেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে ‘চতুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে চলে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না (ডয়েচে ভেলে, ৩১ অক্টোবর ২০১৭)।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাত্তরের সাতই মার্চ সরাসরি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এনডব্লিউ টিভির দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ মার্চের ঘটনা বর্ণনা করেন।
শেখ মুজিবের কাছে ফ্রস্ট জানতে চান, ‘আপনার কি ইচ্ছা ছিল যে, তখন ৭ মার্চ রেসকোর্সে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেবেন?’ জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে এবং সভায় আমি ঘোষণা করি যে এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার।’
ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন ‘আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তো কী ঘটতো’? শেখ মুজিব উত্তর দেন, ‘বিশেষ করে ওই দিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কেননা বিশ্বকে তাদের আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন তাই আঘাত হানা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।’
সাতই মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিমশাল, যা প্রজ্জ্বলিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের দাবানল, যার সামনে টিকতে পারেনি হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কেই নাড়া দেয়নি, ভাষণটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ ভাষণের মধ্যে দিয়ে সমগ্র জাতিকে মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন শেখ মুজিব। তিনি একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন।
সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরত নেওয়া, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা। এ চারটি শর্ত দিয়ে একদিকে আলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখলেন, অপরদিকে বক্তৃতা শেষ করলেন এই কথা বলে যে—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলেন।
তিন.
কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে দেখেছেন অমর কবিতা হিসেবে। আর বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করেছেন কবি হিসেবে। তিনি তার ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতার শেষাংশে লিখেছেন, “শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে, / রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে / অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন / তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা / জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা / কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী? / গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি; / ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম / এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।’’
একটি সাক্ষাৎকারে নির্মলেন্দু গুণ বলেন, ‘একটি অমর কবিতার সব গুণ আছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। এরমধ্যে রয়েছে কাব্য এবং কাব্যিক ঢং। কাব্যগুণ সম্পন্ন বলেই হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুখস্থ বলতে পারে। অন্য কোনো ভাষণ এভাবে স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে মুখস্থ বলতে পারে বলে আমার জানা নেই। কাব্যগুণ সম্পন্ন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু আমিই যে বঙ্গবন্ধুকে কবি বলেছি, তা কিন্তু নয়। পশ্চিমা বিশ্ব তাকে বলেছে ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স’। তার ভাষণ শুনে নিউজ উইক তাকে পোয়েট অব পলিটিক্স বলেছে, কারণ, তার শব্দচয়ন মানুষকে সম্মোহিত করতো, ধরে রাখতো।’
চার.
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের নানা দিক বিশ্লেষণ করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হারুন অর রশীদ। তার বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আর সেগুলো হলো, ১. বাঙালির সংগ্রাম ঐতিহ্য এবং বঞ্চনার ইতিহাস, ২. গণতান্ত্রিক চেতনা, ৩. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, ৪. শান্তির বাণী, ৫. মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ৬. আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ।
বিশ্বজনীনতা এবং মানবিক গুণের কারণেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়েছে। তিনি যে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে কথা বলেছেন এটা সারাবিশ্বের সব মানুষের অধিকার। তাই সারাবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কথা, স্বাধীনতা-বঞ্চিত মানুষের কথা বলেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানুষের সর্বজনীন অধিকার।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছেন, ‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্তু একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেবো’—এরচেয়ে আর বড় কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হতে পারে না। তিনি বলেছেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু বা মুসলমান, বাঙালি বা অবাঙালি সকলেই এ দেশের সন্তান, তাদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব হলো জনগণের।’ তিনি পার্টির নেতা-কর্মীদের বলেছেন আমাদের যেন বদনাম না হয়।
পাঁচ.
এই ভাষণটি আজও আমাদের জাতীয় জীবনের অনুপ্রেরণা। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের পথ দেখায়। পথ হারানোর ক্ষণে কিংবা দেশবিরোধী শত্রুদের ষড়যন্ত্র আর আস্ফালনে দিশেহারা মুহূর্তে যেন বেজে ওঠে সেই অপ্রতিরোধ্য বজ্রকণ্ঠ—‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি ...!’
হাবীব ইমন ।। সাংবাদিক