৭ই মার্চের ভাষণ ও আলতাফের ভাবনা
৭ মার্চ ১৯৭১। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। সেই ভাষণ শুনে আলতাফ মাহমুদ তার ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় ফিরেছেন মাত্র। মুখটা বেশ গম্ভীর। এসেই হাতমুখ ধুয়ে বসার ঘরে এসে বসলেন। অন্যান্য দিন বাসায় ফিরে প্রথমেই বেশ হইচই করে সবার সাথে সারাদিনের গল্প করেন তিনি।
আজ যে কী হলো! এসে শুধু এক কাপ চা চাইলেন স্ত্রী সারা আরা মাহমুদ (ঝিনু)-র কাছে। চা টেবিলে রেখে ঝিনু জিজ্ঞাসা করল, তুমি এত চুপচাপ কেন? রেসকোর্সে যাওনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে?
বিজ্ঞাপন
আলতাফ উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো। কিন্তু মুজিব ভাই আজ স্বাধীনতার ঘোষণা সরাসরি দিলেন না। তিনি বললেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।
আরও পড়ুন
– আর কী বললেন?
– তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
– এটাই তো স্বাধীনতার ডাক।
– তা অবশ্যই। তবে আমি ভেবেছিলাম আজই তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। অবশ্য আমার বিশ্বাস তিনি হয়তো ঠিক সময়ের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করার অপেক্ষায় আছেন।
বঙ্গবন্ধুর সাথে আলতাফ মাহমুদের আলাপ ১৯৫৪ সালের গোঁড়ায়। আলতাফের বয়স তখন একুশ আর বঙ্গবন্ধু চৌত্রিশ। বঙ্গবন্ধু তখন আওয়ামী লীগের মহাসচিব। আলতাফের শক্তিশালী কণ্ঠ ও সুরের সাথে তার সখ্যতা হয়েছিল তখন থেকেই।
বঙ্গবন্ধুর ওপরে এমনই ভরসা ছিল আলতাফের। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আলতাফ মাহমুদ গণসঙ্গীতের মানুষ ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তর তিনি সুদৃঢ় পথ এঁকে চলেছেন। সুরের সাথে বসবাস হলেও আপাদমস্তক রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সাথে আলতাফ মাহমুদের আলাপ ১৯৫৪ সালের গোঁড়ায়। আলতাফের বয়স তখন একুশ আর বঙ্গবন্ধু চৌত্রিশ। বঙ্গবন্ধু তখন আওয়ামী লীগের মহাসচিব। আলতাফের শক্তিশালী কণ্ঠ ও সুরের সাথে তার সখ্যতা হয়েছিল তখন থেকেই। পরবর্তীতে সকল নির্বাচন, রাজনৈতিক আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধুর সাথে সুরের দাবি নিয়ে হেঁটেছেন আলতাফ মাহমুদ।
৭ই মার্চের ভাষণ, আলতাফ মাহমুদের কাছে ছিল বেদবাক্য। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি বাক্য তিনি নিজ দায়িত্বে পালন করে গেছেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে, যতদিন বেঁচে ছিলেন।
আরও পড়ুন
পহেলা মার্চ থেকেই অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সেদিন বিকেল থেকেই থমথম করছিল পুরো শহর। নিজ গাড়িতে কালো পতাকা ঝুলিয়ে ছিলেন সেদিন থেকেই। নানা রকম গুজব ভাসছিল বাতাসে। বাথরুমে প্রায় চল্লিশ গ্যালন পেট্রল মজুত করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। যুদ্ধ হলে মলোটভ বোমা তৈরি করার জন্য। তিনি বুঝেছিলেন আজ হোক কাল হোক শত্রু পক্ষের মিলিটারির সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য। তাই ঐ পেট্রলের এক কণাও গাড়ির জন্য খরচ করেননি।
৭ মার্চের ভাষণ থেকেই আর সবার মতো তিনিও বুঝে নিয়েছিলেন দেশে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। বাসার সব জানালার কাঁচ কালো রঙ দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন তিনি। বাড়ির দরজায় কালো রঙ দিয়ে তুলিতে এঁকেছিলেন অ, আ, ক, খ অক্ষরগুলো।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য গান তৈরি করে মেলাঘর পাঠাতেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বান, যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধ করার সাথে একাত্ম হয়ে এবং একসময় ঢাকার গেরিলা বাহিনী ক্র্যাক প্লাটুনের সাথে সরাসরি জড়িত হয়ে যান।
ঢাকায় অবস্থিত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ, আশ্রয়, গেরিলা মিটিং এবং মেলাঘরের সাথে তথ্য আদানপ্রদান তার বাড়িতেই সংগঠিত হতো। তার দুর্গবাড়ি ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে নির্ভরশীল জায়গা। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা হয়তো এই জন্যই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৭১ সালের ১ মার্চ। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন বেতার ভাষণে অনুষ্ঠিতব্য ৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়া খানের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লে রাজপথে জনগণ বিক্ষোভে অংশ নেন।
ঢাকায় অবস্থিত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ, আশ্রয়, গেরিলা মিটিং এবং মেলাঘরের সাথে তথ্য আদানপ্রদান তার বাড়িতেই সংগঠিত হতো। তার দুর্গবাড়ি ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে নির্ভরশীল জায়গা। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা হয়তো এই জন্যই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেন। বিভিন্ন বিভাগীয় শহরেও সংগ্রামী জনতা বিক্ষোভ করেন। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। এই স্লোগানে বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দাবি তুলতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ ও ৩ মার্চ সর্বাত্মক হরতাল পালনের ঘোষণা দেন এবং ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভার ঘোষণা দেন। কার্যত মার্চের ১ তারিখ থেকেই দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় অসহযোগ আন্দোলন।
জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনার এই চার মূলনীতি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
আরও পড়ুন
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আলতাফ মাহমুদের অসংখ্য মতো মানুষের জন্য বয়ে এনেছিল স্বস্তি, ভূমি স্বাধীনের আনন্দ বার্তা। সেই ভাষণে ছিল আস্থা, শক্তি, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং মানুষের মাঝে অসাম্প্রদায়িক বন্ধনের কথামালা। তাই শিক্ষক, শিল্পী, লেখক থেকে শুরু করে কৃষক, গৃহিণী, জেলেরাও যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে দেশ স্বাধীনের জন্য একাত্তরে এক অবিস্মরণীয় মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্য রচনা করে গেছেন।
এই মহাকাব্য সুরের বরপুত্র আলতাফ মাহমুদের মধ্যে যতটা প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছে, ততটাই ক্রিয়াশীল ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যেও। তাই এই ভাষণ নিয়ে তরুণ প্রজন্ম আলাদাভাবে গবেষণা করতে পারেন, যাতে তারা খুঁজে পাবে নতুন সঞ্জীবনী, নতুন রসদ।
শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা