সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন কেন জরুরি
আমরা প্রায়ই বলে থাকি, ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। মানব উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসাবে স্বাস্থ্য সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) এবং ১৮(১) অনুসারে চিকিৎসাসহ জনগণের পুষ্টি স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।
সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত অন্যতম খাত স্বাস্থ্য। বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছরে এ খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্য ছাড়াও অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির বিস্তার, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ ও মৃত্যু হার নিম্নমুখী, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রীর নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩০-এ আনয়ন, গড় আয়ু বেড়ে ৭২.৮ বছর, অপুষ্টি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে দেশব্যাপী ভিটামিন এ ও ফলিক এসিড বিতরণ—এ সবই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সফলতার চিত্র।
বিজ্ঞাপন
সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় এখনো যথাযথ দক্ষতার মিশ্রণের অভাব রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে বিপুলসংখ্যক স্বাস্থ্য সেবা কর্মীর ব্যবস্থাপনা, দুর্গম এলাকায় পদায়ন ও উপস্থিতির সমস্যা এবং কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি রয়েছে স্বল্প ব্যয়ে চিকিৎসা সেবাদান, ঔষধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের মতো বহুবিধ চ্যালেঞ্জ।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বাংলাদেশে নতুন রোগের আবির্ভাব, নগরমুখী প্রবণতার ফলে শহরের ক্রমবর্ধিষ্ণু দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষত বস্তিবাসীর মধ্যে নিরাপদ পানির অভাব, নিম্নমানের গণশৌচাগার ও অপুষ্টির ফলে সৃষ্ট রোগ/ব্যাধি ইত্যাদি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। নাগরিক সেবা ব্যবস্থাপনায় এখনো রয়ে গেছে সেবা প্রদানকারী এবং সেবা গ্রহীতার মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অভাব।
সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় এখনো যথাযথ দক্ষতার মিশ্রণের অভাব রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে বিপুলসংখ্যক স্বাস্থ্য সেবা কর্মীর ব্যবস্থাপনা, দুর্গম এলাকায় পদায়ন ও উপস্থিতির সমস্যা এবং কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি রয়েছে স্বল্প ব্যয়ে চিকিৎসা সেবাদান, ঔষধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের মতো বহুবিধ চ্যালেঞ্জ।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা-সবার জন্য স্বাস্থ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সবার জন্য সমানভাবে স্বাস্থ্যসেবা বিনা মূল্যে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশও এই ধারায় এগিয়ে চলছে। এর সঙ্গে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধীরাও আছে, তাদেরও যুক্ত করার কথা হচ্ছে। আর তাদের যুক্ত করার জন্যই সর্বজনীন কথাটা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
চিকিৎসাসেবা সকল মানুষের অধিকার হলেও এখন এটা পেতে মানুষকে ক্ষেত্রবিশেষে তদবির করতে হয়। আমরা যারা শহরে বাস করি বা যারা উচ্চবিত্ত তারা যে ধরনের স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকি। সারা দেশের নিম্নবিত্ত মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ কিংবা যারা প্রতিদিনের জীবন-জীবিকা প্রতিদিন নির্বাহ করে, তাদের ক্ষেত্রে এই সেবাটা কিন্তু এক রকমের নয়।
তাদের স্বাস্থ্যসেবার জায়গাটা নিয়ে যদি আমরা ভাবি, তাহলে সেখানে আমরা অনেক বিরূপ চিত্র দেখতে পাই। আমরা যদি আমাদের হাসপাতালগুলোর দিকে তাকাই, তাহলেও আমরা সেই দৃশ্য দেখতে পাই। এর বাইরে যে ক্লিনিকগুলো আছে, সেখানেও তো আমাদের নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ পৌঁছতে পারে না।
আর সারা বিশ্বের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাদের সরকার বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে যে ধরনের স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকে, তারা যে ধরনের নাগরিক সুবিধা পেয়ে থাকে বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের জন্য যা যা করা হয়, তার বেশিরভাগই আমরা আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য করতে পারি না বা তাদের সেই সেবাটা আমরা দিতে পারি না। কিন্তু আমরা যদি একটা উন্নত দেশের কথা ভাবি, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবি, দেশকে বড় জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবি—তাহলে কিন্তু সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। দেশ কখনো একা বড় হয় না। দেশ বড় হয় সবাইকে নিয়ে।
আমরা যদি আমাদের হাসপাতালগুলোর দিকে তাকাই, তাহলেও আমরা সেই দৃশ্য দেখতে পাই। এর বাইরে যে ক্লিনিকগুলো আছে, সেখানেও তো আমাদের নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ পৌঁছতে পারে না।
করোনাকালীন সময়ে আমরা দেখছি একটি আইসিইউ পেতে প্রভাবশালীদেরও হিমশিম খেতে হয়েছিল। রিজেন্টসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিও সামনে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সত্ত্বেও জেলা হাসপাতালগুলোতে গত দুই বছরেও আইসিইউ সুবিধা চালু করা সম্ভব হয়নি।
উপজেলা বা থানা পর্যায়ে ডাক্তারের অভাব, সাধারণ রোগের জন্য রক্তের পরীক্ষা, অন্যান্য ডায়াগনোসিস/টেস্ট হয় না। ফলে রোগীদের জেলা বা বড় শহরের হাসপাতালে আসতে হয়। জেলা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালের তুলনায় প্রাইভেট চেম্বারে বেশি আগ্রহী, সকল শ্রেণির মানুষের জন্য ন্যূনতম ওষুধও পাওয়া যায় না।
ওষুধ বাইরে বেশি দামে কিনতে হয়। দালালের দৌরাত্ম্য, অসাধু চক্রের পাল্লায় পড়ে অনেকে সর্বশান্ত হয়ে পড়েন তাও সঠিক চিকিৎসা পান না এমন নজিরও রয়েছে। এসব অব্যবস্থাপনার ব্যাপারে অভিযোগের আঙুল উঠে ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয় ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে।
তবে এটাও ঠিক দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় জনবলের স্বল্পতাসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। এর মধ্যে সেবা প্রদান করা তাদের জন্য কঠিন। তারা নিরাপত্তার অভাব ও অনেক সময়ই সহিংসতার শিকার হন। রাতে এবং উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসক ও নার্সরা এর শিকার। (সূত্র : প্রথম আলো) বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার কারণ বিলম্বে চিকিৎসা দেওয়াকে কেন্দ্র করে।
বাংলাদেশে রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের ক্রমাবনতি, অনাস্থা, অসন্তুষ্টি সমস্যাগুলো পুরনো। গবেষণা বলছে, সঠিক রোগ নির্ণয়, কার্যকর চিকিৎসা এবং চিকিৎসার ফলাফল বা ট্রিটমেন্ট আউটকাম নির্ভর করে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্কের ওপর। চিকিৎসা সেবা নিয়েও রয়েছে বিপরীত বক্তব্য। আমরা মনে করি, সমস্যাগুলো পুরাতন ও বহুমাত্রিক হলেও দূরত্ব কমাতে আলোচনা, প্রয়োজনে মাসিক গণশুনানি ও চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি ।
জেলা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালের তুলনায় প্রাইভেট চেম্বারে বেশি আগ্রহী, সকল শ্রেণির মানুষের জন্য ন্যূনতম ওষুধও পাওয়া যায় না।
সরকারের ভিশন হলো, ‘সুস্থ জাতি সমৃদ্ধ দেশ’। মিশন হলো, স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়নের মাধ্যমে সবার জন্য গুণগত স্বাস্থ্যসেবা ও পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করা। তা নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
ক) দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবিমা পলিসির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকার প্রয়োজনে এ পলিসির প্রদানের উদ্যোগ নিতে পারে। এই প্রিমিয়ামের অর্থ চিকিৎসকসহ অন্যান্যদের বেতন ভাতা বাবদ বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা প্রার্থী নাগরিকের অধিকার ও চিকিৎসকের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে;
খ) হাসপাতালগুলোতে দালালের দৌরাত্ম্য বন্ধ ও গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিয়মিত গণশুনানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে;
গ) ডাক্তারদের স্বতন্ত্র বেতন-কাঠামো তৈরি করে তাদেরকে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে আর্থিক নিশ্চয়তার বিধান করলে তাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসে অনেক সময় যে নৈরাজ্য চলে তা কিছুটা হলেও কমবে;
ঘ) উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে;
ঙ) আত্মীয়করণ বদলি প্রথা বন্ধ করা প্রয়োজন;
চ) তরুণ চিকিৎসকের বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য প্রেষণা প্রদান প্রয়োজন;
ছ) ওষুধ, খাবার ও অন্যান্য সকল কেমিকেল, মেডিকেল মালামাল ক্রয়ে পিপিআর-৮ (ই-টেন্ডার) প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে। বাৎসরিক প্রয়োজন নির্ধারণ করতে হবে যেন ঘাটতি না পড়ে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি। আমরা মনে করি, চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিদ, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, পেশাজীবী সংগঠন, নাগরিক সমাজ বসে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের এখনই উপযুক্ত সময়।
ড. মো. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। অধ্যাপক ও গবেষক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
khasru73@juniv.edu