সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা ও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার ঘোষণা করেছেন, যার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল নাগরিক পেনশন ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবেন। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরাও এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন। এ ব্যবস্থার অধীনে সুবিধাভোগীরা ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর ধরে প্রতি মাসে একটি নির্ধারিত অর্থ জমা দেওয়ার মাধ্যমে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে পেনশনের সুবিধা পাবেন।
সুবিধাভোগীর জমাকৃত অর্থের পাশাপাশি সরকারও সুনির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ তহবিলে জমা করবে এবং এই তহবিলের অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে যে মুনাফা পাওয়া যাবে পেনশনভোগীরা সে মুনাফারও সুবিধা পাবেন।
বিজ্ঞাপন
পেনশন তহবিলে বিনিয়োগকারীরা ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আমৃত্যু তাদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণের সাপেক্ষে পেনশন ভোগ করতে পারবেন। তবে পেনশনভোগী যদি ৭৫ বছর বয়সের আগে মারা যান তবে পেনশনভোগীর নমিনি পেনশনভোগীর ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত ওই পেনশন ভোগ করতে পারবেন।
এছাড়া তহবিলে বিনিয়োগকারী যদি ১০ বছর বিনিয়োগের পূর্বেই মারা যান তবে ওই তহবিলের অর্থ মুনাফা সমেত তার নমিনিকে ফেরত দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। সরকার কর্তৃক ঘোষিত এই পেনশন ব্যবস্থার অধীনে যদিও জমাকৃত অর্থ এককালীন উত্তোলনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি, তবে আবেদনের প্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত উত্তোলন করা যেতে পারে যা আবার পরবর্তীতে সুদসহ ফেরত দিতে হবে।
সুবিধাভোগীরা ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর ধরে প্রতি মাসে একটি নির্ধারিত অর্থ জমা দেওয়ার মাধ্যমে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে পেনশনের সুবিধা পাবেন।
পেনশন তহবিলের ব্যবস্থাপনার জন্য আইন/বিধি প্রণয়ন ও পৃথক একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে যাতে করে আগামী এক বছরের মধ্যেই এটি কার্যকর করা যায়। শুরুতে ঐচ্ছিক হলেও পরবর্তীতে এই পেনশন ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
সন্দেহ নেই যে, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সর্বজনীন পেনশনের এই ঘোষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রস্তাবনা, যা কর্মজীবী মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে। এর আগে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতেও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়েছিল।
পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের প্রাক্কলন অনুযায়ী, বর্তমানে ৬০ বছরের অধিক জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ৮.৩ শতাংশ, সেই অনুপাত ২০৩০ নাগাদ বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১১.৬ শতাংশে ও ২০৪০ সাল নাগাদ ১৬.২ শতাংশে। এর পাশাপাশি দেশের মানুষের সার্বিকভাবে গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাওয়ায় বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য এধরনের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি বর্তমানে আরও বেশি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য শুধুমাত্র বয়স্ক ভাতার প্রচলন আছে, যার আওতায় ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৫৭.০১ লাখ বয়স্ক বার্ষিক ৬০৪২ টাকা করে এই ভাতা পাচ্ছেন (বাজেট ২০২১-২২ অনুযায়ী)। সুতরাং দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই জীবনযাপনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় আর্থিক সুরক্ষা বলয়েরও বাইরে অবস্থান করছেন। সে প্রেক্ষিতে সর্বজনীন পেনশন বৃদ্ধ বয়সে তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায় হতে পারে।
সরকার কর্তৃক ঘোষিত এই পেনশন ব্যবস্থার অধীনে যদিও জমাকৃত অর্থ এককালীন উত্তোলনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি, তবে আবেদনের প্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত উত্তোলন করা যেতে পারে...
তবে মনে রাখতে হবে যে, এধরনের দীর্ঘমেয়াদী ও অর্থবহুল কর্মসূচি যার আওতায় বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী রয়েছে তার সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করবে নিয়মতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ওপর। এছাড়া বাংলাদেশে ঠিক কোন ধরনের মডেলের ওপর ভিত্তি করে পেনশন তহবিল গঠন করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জরুরি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক প্রস্তাবিত একাধিক স্তম্ভের মডেল (Multi-Pillar Model of ILO) অনেক দেশেই প্রচলিত, যার অধীনে সকল বয়স্ক জনগোষ্ঠী একটি ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে কর্মজীবীরা নিয়োগকারী ও বেতনভুক কর্মীদের বাধ্যতামূলক আবেদনের মাধ্যমে একধরনের সামাজিক বিমা কর্মসূচির আওতায় সুরক্ষিত থাকেন।
অনেক দেশ ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন জনগোষ্ঠীর পেনশন তহবিলে অর্থ জোগান দিয়ে থাকেন। ভারত, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়ার মতো দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের পেনশনের পরিমাণ ও কাঠামো ঠিক করা যেতে পারে ও চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
এছাড়া তহবিল সংক্রান্ত আইন/বিধি প্রণয়ন, কর্তৃপক্ষ গঠন ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়াগুলো সময়সাপেক্ষ তাই প্রয়োজনীয় সময় নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ধাপে ধাপে তহবিলের কাজটি করাই যুক্তিসংগত হবে। যেমন প্রথমেই সতর্কতার সাথে সংশ্লিষ্ট বিধি প্রণয়ন ও পেনশন তহবিল সংক্রান্ত কর্তৃপক্ষ গঠনের কাজটি করতে হবে। পরবর্তী ধাপে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে বর্তমানে পেনশনভোগী (মূলত সরকারি চাকরিজীবী যারা পেনশন পাচ্ছেন) বাদে অন্যান্য সকল বয়স্কদের একধরনের ভাতা কিংবা সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় আনতে হবে।
পরবর্তীতে শ্রমবাজারে নিযুক্তদের বিশেষ করে ব্যক্তিখাতে নিয়োজিতদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে যেখানে পেনশন তহবিল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও তার নিয়োগ কর্তা এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিবেন। এছাড়া অপেক্ষাকৃত অবস্থাসম্পন্ন কর্মজীবীদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনার সাথে সাথে আরেকটি স্তরে চিন্তা করা যেতে পারে।
পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের প্রাক্কলন অনুযায়ী, বর্তমানে ৬০ বছরের অধিক জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ৮.৩ শতাংশ, সেই অনুপাত ২০৩০ নাগাদ বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১১.৬ শতাংশে ও ২০৪০ সাল নাগাদ ১৬.২ শতাংশে।
তবে প্রাথমিক পর্যায়ে সব স্তর, সব পেশা, কিংবা সব খাতকে বিবেচনা না করে বরং ধাপে ধাপে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যুক্তিসংগত হবে। এছাড়া পুরো প্রক্রিয়ার সাথে যেহেতু বিভিন্ন পেশার মানুষ সম্পর্কিত তাই তহবিল সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের সাথে বিশদভাবে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। যেমন সময়কাল, তহবিলে সরকারের আর্থিক অবদান, ন্যূনতম জমাকৃত অর্থের পরিমাণ, জমাকৃত অর্থের বিনিয়োগের সম্ভাব্য খাত সমূহ ও সেই বিনিয়োগ থেকে পেনশনভোগীদের প্রাপ্ত সুদ ও লভ্যাংশের বিশদ বিবরণ ইত্যাদি বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে ও এ ব্যাপারে স্বচ্ছতা থাকা জরুরি।
পেনশন তহবিলের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে আর একটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচ্য হওয়া প্রয়োজন, যেটি হচ্ছে সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য আর্থিক ইন্সট্রুমেন্টে বিনিয়োগের সাপেক্ষে পেনশন তহবিলে বিনিয়োগে সঞ্চয়কারী কতটা সুবিধা পাচ্ছেন।
যদিও উচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্র দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের টেকসই মাধ্যম নয় ও বাজার ব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক, মধ্যবিত্ত অবসর ভোগীদের জন্য সঞ্চয়পত্র একটি জনপ্রিয় বিনিয়োগ মাধ্যম এবং অবসরকালীন সময়ে অর্থ জোগানের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তাই এ প্রেক্ষিতে পেনশন তহবিলে বিনিয়োগকে আকর্ষণীয় করার জন্য উপযুক্ত কাঠামো প্রণয়ন করার বিষয়টিও বিবেচনায় থাকা প্রয়োজন।
তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে এধরনের তহবিল গঠনের ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের এই তহবিলের আওতায় আনা। এ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য তহবিলে ধারাবাহিকভাবে অর্থের জোগান দেওয়ার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট আয়ের নিচে যারা রয়েছেন তাদের জন্য সহজ ও শিথিল শর্তে বিকল্প ব্যবস্থার বিষয়ে ভাবা যেতে পারে।
এর পাশাপাশি মনে রাখা দরকার যে, আমাদের দেশের বড় অংশ মানুষই কিন্তু এখনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে রয়েছে। এদেরকে আর্থিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অতি দ্রুতই পদক্ষেপ নিতে হবে।
সর্বোপরি এ ধরনের বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই। তবে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট আইন/বিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সঠিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করাই সর্বজনীন পেনশনের সাফল্যের ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা ।। অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়