মুক্তচিন্তা ও সাংবাদিকতা
১
‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ উপমহাদেশ বিভক্তির সময়কালে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে নিবেদিত ঢাকায় শিখা গোষ্ঠীর তরুণদের শ্লোগান ছিল এই বাক্যটি। তারা এই বাস্তবতাকে পাল্টাবার প্রতিজ্ঞায় এই পরিস্থিতির অপনোদনের ব্রতী হয়েছিলেন, উদ্যোগী হয়েছিলেন, যুগ যুগ ধরে অন্ধকারে ঢাকা পড়ে থাকা দুর্ভাগ্য পীড়িত মানুষের মাঝে আলোকবর্তিকা জ্বালাবার। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা সফল হয় নি। তাদেরকে দমিয়ে দেয়া হয়েছিল। আড়ষ্ট বুদ্ধির রজ্জুতে তাদের গলায় ফাঁস পড়ানো হয়েছিল। সেই ফাঁস তাদের যাত্রাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ফলে সমাজের জমাটবদ্ধ সেই অন্ধকার এখনো ঘোঁচেনি। ইত্যবসরে পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে, দেশের অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। কিন্তু আসেনি সে প্রত্যাশিত আলো।
বিজ্ঞাপন
সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এই ভূখণ্ড ১৯৭১-এ অনেক রক্ত আর আত্মোৎসর্গের অহংকারে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতাও অর্জন করেছে। এতো বছরেও এখনো ঘোঁচেনি সেই আঁধার। মুক্ত হল দেশ-ভূখণ্ড কিন্তু মুক্তি এলো না, উল্টো আরও পদে পদে প্রতিবন্ধকতার শেকলে বদ্ধ হল পা-ও। আর যার হাত-পা উভয়ই বাঁধা তার মন তো এমনিতেই বাঁধা পড়ে নানাবিধ শেকলে। তবুও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ‘দুঃসময়’ কবিতার পংক্তির মতো প্রয়াস এই রচনা। তার ভাষায়-
“যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা—
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।”
এ লেখা যেন সেই বিহঙ্গের পাখার ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ঝাপটানি। জ্ঞান হচ্ছে মুক্তির চাবিকাঠি। মানব সভ্যতা জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ তারায় তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। বর্তমান সময়কে বলা হয় জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ। জ্ঞান পরিচালনা করছে প্রতিটি জীবন, প্রতিটি মুহূর্ত আর সেই জ্ঞান ভিত্তিক সমাজে আমাদের অবস্থানটি কি? একেবারে তলানিতে। বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকের (গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সের) বিশ্বের ১৩৮টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১২-তে, অর্থাৎ ১০০-এর মধ্যেও নেই। আবার উচ্চশিক্ষার তালিকার সূচকে আমাদের অবস্থান ১২৯-এ। এই হচ্ছে আমাদের জ্ঞানের অবস্থান সূচক। আমাদের নানা গর্ব অহংকারের সীমা-পরিসীমা নেই এও তো এক অহংকারের রাজটিকা বটেই!
২
যে কারণে উপর্যুক্ত দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা, তা হল আমরা পেশাজীবী সাংবাদিকরা বলা চলে দেশ বিভাগের পর থেকেই স্বাধীন সাংবাদিকতার অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে আসছে সে লড়াই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক শোষক শ্রেণির সময়ে, সে লড়াই ছিল স্বাধীন দেশের মাটিতেও।
সত্য প্রকাশের অপরাধে (?) আজ জুলিয়াস অ্যাসাঞ্জ বন্দী, এডওয়ার্ড স্লোডেন নির্বাসিত, কারাগারে নিক্ষিপ্ত মিয়ানমারের দুই সাংবাদিক দণ্ড খাটছে। জেল খাটছে বাংলাদেশের তরুণ কার্টুনিস্ট কিশোর।
সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম যেন সরকার তো বটেই, তার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের সংঘবদ্ধ যেকোনো কোটার স্বার্থ গোষ্ঠীর জন্য চক্ষুশূল। অন্ধকারের প্রাণী পেঁচা নাকি আলো সহ্য করতে পারে না চোখে এক্ষেত্রে পেঁচার সংখ্যা যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বাধীন দেশের সমাজে। মহল্লার ছিঁচকে মাস্তান থেকে দুর্নীতিবাজ আমলা, অসৎ জনপ্রতিনিধি সবার চোখে অসংখ্য জোনাকির মতো সামান্য আলোও অসহনীয় ব্যাপার। এমনই বাস্তবতায় ‘মুক্ত চিন্তার সাংবাদিকতা’র ‘সোনার পাথর বাটি’ না হয়ে কি উপায়।
৩
না, এ শুধু বর্তমানে বাংলাদেশের বাস্তবতা নয়, পৃথিবীর নানা দেশেই এ যেন আজ এক স্বাভাবিক ঘটনা। সত্য প্রকাশের অপরাধে (?) আজ জুলিয়াস অ্যাসাঞ্জ বন্দী, এডওয়ার্ড স্লোডেন নির্বাসিত, কারাগারে নিক্ষিপ্ত মিয়ানমারের দুই সাংবাদিক দণ্ড খাটছে। জেল খাটছে বাংলাদেশের তরুণ কার্টুনিস্ট কিশোর। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা তার মুক্তি চাইলেও মুক্তি মিলছে না। যে দেশে বুদ্ধি-মুক্তির আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে সে দেশে মুক্তচিন্তার প্রয়াস কতটা বাস্তবসম্মত তা কে বলবে? উপরন্তু মুক্তচিন্তার সাংবাদিকতা তো বটেই পৃথিবীব্যাপী মুক্তচিন্তাই আজ সবচাইতে বড় আক্রান্ত বিষয়। যদিও জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় ‘ধারা-১৯’-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- ‘প্রত্যেকেরই মতামত পোষণ এবং যেকোনো উপায়ে ও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও মতামত সন্ধান, গ্রহণ ও জাত করার স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।’
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মানবাধিকারের এই সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণ ও জারি করে। আজও এই ঘোষণাকে পৃথিবীব্যাপী ‘সর্বজনীন’ করাই সম্ভব হয়নি। জাতিসংঘ আমাদের যে অধিকার দিয়েছে সেটা যে কতটা দূরে বাস্তব থেকে তা উপলব্ধি করা যায় উইকিলিকস-এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বন্দী জীবন থেকে। প্রতীয়মান হয় এডওয়ার্ড স্লোডেন-এর রাশিয়ায় নির্বাসিত জীবন থেকে। উপর্যুক্ত উভয় সর্বজনীন অধিকারকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মানুষের জন্য সার্বজনীন করা সম্ভবপর হয়নি এখন পর্যন্ত।
বলাই বাহুল্য, পৃথিবীতে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও পরিবর্তিত বাস্তবতার আলোকে মানবাধিকার সুনিশ্চিত, সুপ্রতিষ্ঠিত করার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে আইন কানুনের পরিবর্তন পরিবর্ধন অবশ্য করণীয়। সেটা ক্রমাগত উৎকর্ষের অভিমুখে হওয়াটাই কাম্য। কিন্তু বাস্তবে যদি দেখা যায় তার বিপরীতটাই ঘটছে তখন সেটা পরম পরিতাপের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বৈকি।
৪
সাংবাদিকতা পেশাটি কেবল মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধির পেশাই নয়, সাংবাদিকতা মুক্ত বিশ্বেরও স্বপ্ন দ্রষ্টা। মুক্ত বিশ্বের ধারণার জন্ম সাংবাদিকতার সূচনা থেকে। সেই মুক্ত বিশ্বের ধারণা প্রদানকারী ব্যতিক্রমী দুঃসাহসী পেশাটিই আজ বন্দিত্বে নিগড়ে নিপতিত। নেপথ্যের কারণ অনেক। বলা যায় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিবিধ শেকলে বন্দী।
সাংবাদিকতা পেশাটি কেবল মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধির পেশাই নয়, সাংবাদিকতা মুক্ত বিশ্বেরও স্বপ্ন দ্রষ্টা। মুক্ত বিশ্বের ধারণার জন্ম সাংবাদিকতার সূচনা থেকে। সেই মুক্ত বিশ্বের ধারণা প্রদানকারী ব্যতিক্রমী দুঃসাহসী পেশাটিই আজ বন্দিত্বে নিগড়ে নিপতিত। ...সাংবাদিকতা বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় অন্য সব পেশার মতই ‘এম্বেডেড জার্নালিজম’ বা পেশায় পরিণত হয়েছে। এর বড় কারণ সংবাদপত্রে কর্পোরেট পুঁজির একচ্ছত্র বিনিয়োগ।
সাংবাদিকতা বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় অন্য আর সব পেশার মতই ‘এম্বেডেড জার্নালিজম’ বা পেশায় পরিণত হয়েছে। এর বড় কারণ সংবাদপত্রে কর্পোরেট পুঁজির একচ্ছত্র বিনিয়োগ। সাংবাদিকতায়, সংবাদপত্রের সামাজিক অঙ্গীকার আজ আর নেই- পরিণত হয়েছে কেবলই বাণিজ্যিক অঙ্গীকারে। পুঁজি সমস্ত কিছুকেই বাণিজ্যে রূপান্তরিত করে তা যেমন হতে পারে দম ফাটানো হাসি তেমনই বুক ফাটা কান্নাকেও।
৫
সাংবাদিকতার পরিসর যেমন হয়েছে বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর- কাঁচা বাজার থেকে মহাশূন্য অভিযান, মৃত্তিকার সর্বশেষ স্তর থেকে অন্তরীক্ষ পর্যন্ত বহুমাত্রিক বাস্তবতা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে রাশিচক্রের কুসংস্কার। যুক্ত হয়েছে ধর্ম, সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক বিষয়াবলীও। যা কি-না মুক্তচিন্তার পেশাকে বদ্ধ জলাশয়ে সন্তরণে ঠেলে ফেলছে। ডানায় উড়বার কথা যার, সে পরিণত হচ্ছে খাঁচার তোতায়। কর্পোরেট পুঁজির শক্তি, পুঁজির স্বার্থ আদায় করে নেবে সেটাই স্বাভাবিক। আর সেই নির্মম কারণেই সভ্যতার ইতিহাসে স্পার্টাকাসের দাস বিদ্রোহের পর যখন দিল্লির কৃষক বিদ্রোহের মত বড় সামাজিক ঘটনা উপমহাদেশের কৃষক আন্দোলনের ঐতিহ্যকে ছাড়িয়ে বিশ্ব ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছে। প্রতিবাদী কৃষকরা যখন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠাণ্ডায় অনড় সাহসিকতায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে তখনও বিশ্ব গণমাধ্যম ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণীকে প্রাধান্যে রাখছে! দিল্লির কৃষকরা যখন রক্ত দিয়ে চিঠি লিখছে প্রধানমন্ত্রীকে তখনও সংবাদপত্র মুখ ঢাকছে মমতার নির্বাচনী ‘আঁচে’ একইভাবে অনেক প্রয়োজনীয় ইস্যু ঢাকা পড়ে যাচ্ছে বাণিজ্যের বাহ্যারম্ভে।
৬
বিশ্ব পরিবেশের বিষয় যা কি-না মানব জাতি এবং মানব সভ্যতার অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বাণিজ্যিক সংবাদপত্রে প্রতিফলিত হতে পারছে না তার গুরুত্বও। সভ্যতার ক্রান্তি লগ্নে দাঁড়িয়ে তাই আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখছি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাই নারী শিক্ষা, নারী অধিকারের পক্ষে তার কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশের অন্ধকারাচ্ছন্ন ভূমিতে আন্দোলনে ব্রতী। আমরা অবাক হয়ে দেখি পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে, বিশ্বের আসন্ন ধ্বংসের বার্তার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থার্নবার্গ সুতীব্র ক্রোধ জানিয়ে জাতিসংঘের ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে সমবেত নেতাদের উদ্দেশে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলছে- ‘আপনাদের অন্তঃসার শূন্য কথা দিয়ে আপনারা আমার শৈশব, আমার স্বপ্ন চুরি করে নিয়েছেন।... কোন সাহসে আপনারা এখনো অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন এবং এখানে এসে বলছেন যে আপনারা যথেষ্ট করেছেন, যখন প্রয়োজনীয় নীতি বা সমাধানের চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না। .... আপনার যদি আমাদের হতাশ করেন, তাহলে বলতে পারি যে, আমরা আপনাদের কখনোই ক্ষমা করবো না।’
সোজাসাপ্টা একথা যদি বলি, যে কথা বলার কথা গণমাধ্যমের, সেকথা বলছে সদ্য কৈশোরেও পা রাখা গ্রেটা থার্নবার্গ ও মালালা ইউসুফজাই। তরুণেরা পৃথিবীর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠছে আর প্রবীণেরা নিঃশব্দ নিস্তব্ধ। ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটির অধিবেশনে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল তার উদ্বোধনী ভাষণে প্রণিধানযোগ্য একটি উক্তি করেছেন তিনি বলেছেন- ‘প্রকৃতি আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ এবং আমরা যদি ভাবি প্রকৃতিকে বোকা বানাবো, এতে আমরা নিজেদেরকেই বোকা বানাচ্ছি, কারণ প্রকৃতি সব সময়েই পাল্টা আঘাত করে এবং বর্তমানে সারা বিশ্বেই সেই আঘাত তীব্রতর হচ্ছে।’
গ্রেটা থার্নবার্গ-এর ক্রোধ প্রকাশের কয়েক মাস পেরুতে না পেরুতেই ‘করোনা মহামারী’র কবলে পড়ে গোটা বিশ্ব স্থবির হয়ে পড়ে তার সেই আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করলো। সত্যি হল জাতিসংঘের মহাসচিবের উক্তিও।
৭
শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক ‘করোনা মহামারী’ও আমাদের সেই অতি পুরাতন সত্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল যে, সাংবাদিকতাকে মুক্তচিন্তা, মুক্ত বিশ্বের স্বপ্নের সহযাত্রী হতে হবে। তার কোনো বিকল্প পথ নেই।
সাইফুল আলম ।। সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর