রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প
পরিপত্রে না থাকলেও পিডি হতে চান উপাচার্য
মেডিকেল প্রকল্প মানেই পদে পদে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা। কুষ্টিয়া, খুলনা ও তাজউদ্দিন মেডিকেলের পর এবার ‘রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (আরএমইউ) স্থাপন’ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। প্রকল্পের বিভিন্ন খাতের ব্যয়ে আপত্তি তুলে সংশোধন করতে বলা হলেও বারবার পরিকল্পনা কমিশনের নির্দেশনা উপেক্ষা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়মিত পরিকল্পনা কমিশনে ধরনা দিয়ে যাচ্ছেন তারা।
বর্তমানে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
গত বছর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় উপাচার্যকে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাবে সম্মতি না দিয়ে পূর্ণকালীন একজন প্রকল্প পরিচালকের সংস্থান রাখতে নির্দেশনা দেয় পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু কমিশনের সেই নির্দেশনা আমলে নেয়নি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ বাস্তবায়নকারী সংস্থা উপাচার্যকেই পিডি হিসেবে দেখতে চাইছে। পরিকল্পনা কমিশনে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে পাঠানো নতুন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) উপাচার্যকে পিডি রেখে সংস্থান চাওয়া হয়েছে।
গত বছর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় উপাচার্যকে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাবে সম্মতি না দিয়ে পূর্ণকালীন একজন প্রকল্প পরিচালকের সংস্থান রাখতে নির্দেশনা দেয় পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু কমিশনের সেই নির্দেশনা আমলে নেয়নি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ
পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে জানান, ‘রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (আরএমইউ) স্থাপন’ প্রকল্পটি গত বছরের মাঝামাঝিতে কমিশনে প্রস্তাব আকারে পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ওই প্রস্তাব আনে।
আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ গত বছরের ২৫ আগস্ট প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করে। ওই সভায় ৩৬টি খাতের ব্যয় ও বিভিন্ন অসঙ্গতি চিহ্নিত করে ডিপিপি ফেরত পাঠায়। একই সঙ্গে এত বড় প্রকল্প না নিয়ে দুই থেকে তিনটি পর্যায়ে প্রকল্পটি নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে এক হাজার ৮৯৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকার নতুন ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করে বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকল্পটির মূল ডিপিপিতে তিন হাজার ৯৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়।
প্রকল্পে যত গলদ
জানা গেছে, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ প্রকল্পটির নতুন ডিপিপি’র ১১ খাতে গলদ চিহ্নিত করে। এসব গলদ নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভাও শেষ করে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ। পিইসি সভার তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পটি সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংশোধন হয়ে আসলে কমিশন আবারও প্রকল্পের ওপর যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেবে।
প্রকল্পের ডিপিপিতে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার জন্য দুই হাজার ১৬৮ মিটার সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হবে। সীমানা প্রাচীর নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ কোটি ১৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। এখানে প্রতি মিটার সীমানা প্রাচীর নির্মাণে ব্যয় হবে সাত লাখ ৯০ হাজার টাকা। একই সঙ্গে পরামর্শক খাতে সাড়ে ২৭ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে ডিপিপিতে।
বর্তমানে এক হাজার ৮৯৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকার নতুন ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করে বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকল্পটির মূল ডিপিপিতে তিন হাজার ৯৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়
একটি ডিজাইন ফার্মের পরামর্শ হিসেবে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩ কোটি ৭৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। একজন প্রকিউরমেন্ট পরামর্শকের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০ লাখ টাকা এবং স্বল্পমেয়াদি পরামর্শক সার্ভিসের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে তিন কোটি টাকা। পরামর্শক খাতের এমন ব্যয় পরিকল্পনা কমিশনও অবাস্তব বলে জানিয়েছে।
এছাড়া প্রকল্পের নির্মাণকাজের ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি গণপূর্ত অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের রেট সিডিউল ধরা হলেও প্রাক্কলনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ অধিদপ্তরের প্রত্যয়ন নেই। প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত নির্মাণকাজ কাদের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে সে বিষয়েও পরিকল্পনা কমিশন জানতে চেয়েছে।
যা বলছে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ
আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের স্বাস্থ্য উইংয়ের উপপ্রধান ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় কিছু শর্ত দিয়ে সুপারিশ করেছি। সেগুলো প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ঠিকঠাক করে পাঠাবে। যেসব খাতে অসঙ্গতি আছে, সেগুলো নিয়ে পিইসিতে আলোচনা হয়েছে। তাদের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। মূলত, অসঙ্গতিগুলো দূর করে পুনর্গঠিত ডিপিপি কমিশনে পাঠাবে তারা।’
উপাচার্যকে পিডি হিসেবে রাখা, না রাখার বিষয়ে পিইসি সভায় কোন ধরনের আলোচনা হয়েছে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিপত্রে বলা আছে, ৫০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্প হলে ফুল টাইম (পুরো সময়) প্রকল্প পরিচালক দিতে হবে। পরিকল্পনা কমিশন এ সুপারিশ সবসময় করে এবং এ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও করা হয়েছে। আমরা পিইসি সভায় বলেছি, এখানে উপাচার্য নয়, একজন পূর্ণকালীন পিডি দিতে হবে।’
পূর্ণকালীন পিডি নিয়োগের বিষয়ে জানতে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম মোস্তাক হোসেনকে গত কয়েক দিন ধরে ফোন করা হয়। কিন্তু তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
উপাচার্যকে না পেলেও এ বিষয়ে কথা বলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ) মো. শাহাদাৎ হোসাইন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে পিইসি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিপিপি সংশোধন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি। পরিকল্পনা কমিশন সংশোধিত ডিপিপি দেখে সন্তুষ্ট হলে তারপর প্রকল্পটি একনেকে যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শুরু থেকে প্রকল্পটিতে অনেক অসঙ্গতি পেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। কমিশন যাচাই-বাছাই করে অসঙ্গতিগুলো তুলে আনে। আমরা প্রথমে প্রকল্পটি একবারে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশে প্রকল্পটি প্রথম ফেজ এখন কমিশনে পাঠানো হয়েছে।’
প্রকল্পের নির্মাণকাজের ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি গণপূর্ত অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের রেট সিডিউল ধরা হলেও এতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ অধিদপ্তরের প্রত্যয়ন নেই। প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত নির্মাণকাজ কাদের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত সচিব শাহাদাৎ হোসাইন বলেন, ‘এ বিষয়ে জানতে হলে আমাদের পরিকল্পনা উইংয়ের যুগ্ম সচিব সালাম খানের সঙ্গে কথা বলেন। প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সবকিছু তিনিই দেখভাল করছেন। তার কাছে সবকিছুর জবাব পাবেন।’
রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে কথা হয় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘অসঙ্গতি নিয়ে কোনো প্রকল্পই পরিকল্পনা কমিশন থেকে একনেকে যাবে না। আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একনেক বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য প্রকল্প চূড়ান্ত করি। সুতরাং ত্রুটি নিয়ে কোনো প্রকল্প অনুমোদন হবে না। প্রকল্পটির বিষয়ে আমি নিজেও খোঁজ-খবর নেব।’
বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের সঙ্গে কথা হয় বিষয়টি নিয়ে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশন তো এখানে এক্সিকিউটিভ কোনো অথরিটি না। যেকোনো প্রকল্পের বিষয়ে তারা দেখবে, মতামত দেবে। কমিশনের মতামত যৌক্তিক না অযৌক্তিক, তা জেনে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হবে। এরপর সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ডিপিপি সংশোধন করা হবে।’
‘পরিকল্পনা কমিশন কোনো কিছুর জন্য বাধ্য করতে পারে না। কিন্তু তাদের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া প্রকল্প এগোয় না’— বলেন এ অর্থনীতিবিদ।
এসআর/এমএআর/