ভিডিও বার্তায় দুদকের ১৩ অভিযোগের জবাব শরীফের
চাকরি থেকে অপসারণের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ১৩ অভিযোগের জবাব দিলেন সংস্থাটির সদ্য সাবেক উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন।
সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) এক ভিডিও বার্তায় তিনি কারণগুলো ব্যাখা করার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে চাকরিতে পুর্নবহালের আকুতি জানিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্টকে দেওয়া ভিডিও বার্তায় অভিযোগগুলো একে একে ধরে ধরে তার সুনির্দিষ্ট জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন দুদকের অপসারণকৃত এই কর্মকর্তা। যেখানে অভিযোগগুলোকে অনেকটা অস্বীকার করতে দেখা গেছে তাকে।
(শরীফ উদ্দিনের পুরো বক্তব্য এই প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত করা ভিডিওতে পাওয়া যাবে)
এর আগে রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন শরীফকে অপসারণের ১৩টি কারণের কথা জানান।
দুদক সচিব বলেন, শরীফ উদ্দিনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বহু অভিযোগ কমিশনে থাকায় তাকে অপসারণ করতে হয়েছে। চাকরি বিধিমালার ৫৪(২) বিধিতে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই অপসারণের বিধান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি অনুযায়ী দুদক ছাড়াও দেশের অন্যান্য বহু দপ্তরে এ রকম আইন ও বিধি বিদ্যমান। কমিশনের শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে কমিশনে বিস্তারিত আলোচনার পর শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়েছে।
দুদকের অভিযোগ ও শরীফের ব্যাখ্যা
দুদকের অভিযোগ— শরীফ কোনো অনুসন্ধান বা তদন্তের দাবি পাওয়া মাত্র দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তের নির্দেশিকা অনুসরণ না করে নিজের খেয়াল-খুশি মতো কাজ করতেন।
শরীফের জবাব— আমি চট্টগ্রামে থাকাকালে যতগুলো অনুসন্ধান ও তদন্ত করেছি, তা সেখানকার উপ-পরিচালক ও পরিচালকের নির্দেশনা অনুসরণ করেই করেছি। আমার নথির সবগুলোর অনুলিপি তাদেরকে প্রদান করতাম। তাদের ইচ্ছা ছাড়া কোনো অনুসন্ধান বা তদন্ত বিধিবহির্ভূতভাবে করেছি? আমি ক্লিয়ার নই। তাছাড়া বদলির এতদিন পর কেন এ বিষয়ে অভিযোগগুলো উত্থাপিত করা হলো? তখন কেন এ বিষয়ে আমাকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। আমি দাবি করব, স্যার আমার সবগুলো রিপোর্ট যাচাই করার পরও কেন এককভাবে আমাকেই দায়ী করা হলো। আমি চরমভাবে জুলুমের স্বীকার হয়েছি।
অভিযোগ— অনুসন্ধান বা তদন্ত করার সময় শরীফ উদ্দিন অভিযোগের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয়, এরকম বহু ব্যক্তিকে নোটিশ বা টেলিফোনের মাধ্যমে ডেকে এনে হয়রানি করতেন।
শরীফের জবাব— আমি বিনয়ের সঙ্গে দ্বিমত করছি। আমি চট্টগ্রামে সাড়ে তিন বছর নিযুক্ত ছিলাম। আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাকে কখনোই এমন বিষয় বলেননি। কাদের ডেকে এনে হয়রানি করেছি, সেটা বললে আরও খোলাসা করতে পারতাম। আমি যতটুকু জানি বেলায়েত ও ইদ্রিস নামের দুই ব্যক্তি এমন অভিযোগ করেছে, যারা মামলা সংশ্লিষ্ট আসামি। যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত চলমান। বেলায়েত ১৬৪ এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেই কাজ শেষ হওয়ার আগেই আমার ওপর এমন ট্যাগ লাগানো হলে জুলুম করা হয় বলে মনে করি।
অভিযোগ— অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে কোনো ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ বা নো ডেবিট করার প্রয়োজন হলে আইন ও বিধিতে তার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। শরীফ ওই নিয়মের তোয়াক্কা করতেন না এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতেন না।
শরীফের জবাব— হাইকোর্ট ‘নো ডেবিট’ এর বিষয়টি অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এটাকে বৈধ বলার সুযোগ নেই। তবে হাইকোর্ট থেকে হেরে যাওয়ার পর আমাদের আইনজীবী আপিল করতে পারতেন। এ ধরনের নজির রয়েছে। আমার খারাপ কোনো উদ্দেশ্য ছিল কি না সেটাও দেখা উচিত। ‘নো ডেবিট’ হলো এক ধরনের অনুরোধপত্র। এটা সাময়িক সময়ের জন্য করা হয়। কিন্তু অভিযোগ করা হয়েছে, আমি নাকি টাকা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছি। এটি কীভাবে সম্ভব? কারণ টাকা ওই হিসাবেই ছিল। তাছাড়া আমার নো-ডেবিটের চিঠির কপি আমার উপ-পরিচালককে দিয়েছি। তারা তো আমাকে কখনোই এ বিষয়ে সতর্ক করেন নাই। নবীন কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে বলতে পারত, আমি বিধির বাইরে কাজ করছি। তা তো তারা করেন নাই।
অভিযোগ— কক্সবাজারে একজন সার্ভেয়ারের বাসায় অভিযান চালিয়ে র্যাব ঘুষের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকা জব্দ করে। জব্দকৃত অর্থ ২০২০ সারের ১০ মার্চ আলামত হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তা শরীফকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে দীর্ঘ এক বছর চার মাস ওই অর্থ নিজের হেফাজতে রেখেছেন। বিষয়টি হাইকোর্ট ডিভিশনের দৃষ্টিতে এলে সুয়োমোটো রুল জারি করা হয়। এ বিষয়ে শরীফের ব্যাখ্যা আদালত গ্রহণ করেননি।
শরীফের জবাব— স্যার ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকা আমি জব্দ করিনি। এটা র্যাব কর্তৃক জব্দ করা হয়। সেখানে অন্যান্য আলামত ছিল। কোভিডকালে আমাদের টিমসহ জব্দ করা টাকা কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসি, যা অফিসিয়াল ভল্টেই রাখি। এ বিষয়ে আমাদের অফিসের উপ-পরিচালক ও পরিচালকরা অবগত ছিলেন। একজন নবীন কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে কেউ বলে নাই, ২৪ ঘণ্টা বা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জমা দিতে হবে, তাহলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও জমা দিতাম। তাছাড়া জব্দ করা টাকা জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া খুবই জটিল।
অভিযোগ— শরীফ উদ্দিন একটি মামলায় ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে অত্যন্ত নির্মমভাবে প্রহার করেছেন, যা তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। আর এ ধরনের বহু অভিযোগ রয়েছে।
শরীফের জবাব— আপনাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে। কক্সবাজারে এলএ কেসে তদন্তে আগত আসামি হিসেবে মো. ইদ্রিস ও নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করি। ইদ্রিসকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডের অনুমতি দেওয়া হয়। রিমান্ডের সময় নিয়মিত নথিমূলে হাসপাতালে চেকআপ করা ও থানায় জমা দেওয়া হতো। এক পর্যায়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। সেখানে কখনও প্রহার করা বা বাধ্য করার কথা বলেননি। এরপর দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে জেলে রয়েছেন। এখন কেন বলছেন? তাছাড়া তিনি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও আসামি, তিনি তো আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেনই। সর্বশেষ এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইকবাল স্যার তদন্ত করেছেন, মেডিকেল রিপোর্ট নিয়েছেন। সেখানে নিয়মিত চেকআপের কথা বলা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের কথা বলা হয়নি।
অভিযোগ— শরীফ উদ্দিনের কর্মকাল তিন বছরের অধিক হওয়ায় অন্য আরও ২০ জন কর্মচারীর সঙ্গে তাকে বদলি করা হয়। এ বদলি আদেশ সবাই যথাসময়ে কার্যকর করেন। কিন্তু বদলির এ আদেশের বিরুদ্ধে শহিদুল ইসলাম লিটন নামের একজন মানবাধিকারকর্মীর ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট পিটিশন দায়ের করেন। বদলির আদেশ স্থগিত করার অসত্য সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু এ ধরনের কোনো আদেশ হাইকোর্ট দেননি।
জবাব— কক্সবাজারে আমার কর্মকাণ্ড ও মানবিকতার কারণে আমরা বদলির বিষয়টি মেনে নেয়নি। আমার বদলি হওয়ার পর লিটনসহ আরও কয়েকজন আমার এ বিষয়ে রিট করে। আমি তাদের চিনি না। এ বিষয়ে দুদক থেকেও তদন্ত করা হয়েছে। সেখানে আমি বক্তব্য দিয়েছি। বিষয়টির সঙ্গে আমি জড়িত নই। আমার চাকরিচ্যুত হওয়ার পরও তো ১০ আইনজীবী আমার পক্ষে নাকি রিট করেছেন। তাদেরও আমি চিনি না। কোনো ব্যক্তি যদি রিট করে থাকেন, আর যদি সে কারণে আমাকে আটকানো হয়। তাহলে আমি বলব চরমভাবে জুলুম করা হচ্ছে।
অভিযোগ— জনস্বার্থে ২০২১ সালের ১৬ জুন সজেকা, চট্টগ্রাম-২ থেকে সজেকা, পটুয়াখালীতে তাকে বদলি করার দীর্ঘ একমাস পর (১৭ জুলাই) তিনি ই-মেইলে পটুয়াখালীতে যোগদানপত্র প্রেরণ করেন। আর ১০ আগস্ট তারিখে সশরীরে দুদকের পটুয়াখালী অফিসে উপস্থিত হন। বিলম্বের কারণ হিসেবে লকডাউন বলে তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু লকডাউনের মধ্যেও সশরীরে পটুয়াখালীতে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ ছিল। বিলম্বে যোগদান করে তিনি কমিশনের আদেশ অবজ্ঞা করেছেন।
শরীফের জবাব— গত ১০ আগস্ট আমি সশরীরে পটুয়াখালী যোগদান করি। আমার সঙ্গে ২১ জনকে বদলি করা হয়। তারাও ওই সময় যোগদান করেন। এক মাস ১০ দিন লকডাউন ছিল। সরকারি সব অফিস ও সরাসরি যান চলাচল বন্ধ ছিল। তাছাড়া সার্ভিস রুল অনুসারে আমি তো সময় পাব। এছাড়া আমি তখন কোভিড আক্রান্ত ছিলাম। যার সব সার্টিফিকেট রয়েছে এবং কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সুতরাং এক মাস ১০ দিন পর যোগদানের বিষয়ে সার্ভিস রুল বিবেচনায় নিয়ে ক্ষমা করা যেত।
অভিযোগ— শরীফ উদ্দিনকে পটুয়াখালীতে বদলির পর কর্মস্থল ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে সব রেকর্ডপত্রসহ নথিপত্র বুঝিয়ে দেওয়ার বিধান রয়েছে। নথি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য কখনোই পৃথক আদেশ জারি করা হয় না। তা সত্ত্বেও দীর্ঘ প্রায় তিন মাস পর তাকে পটুয়াখালী থেকে ডেকে নিয়ে আসা হয়।
জবাব— আমার কাছে ১৩০টি নথিপত্র ছিল। মামলাগুলো অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর ও হাই-সেনসিটিভ ছিল। ছয়টি আলমারিতে সেগুলো ছিল। তা আরেকজনকে বুঝিয়ে দেওয়া সময়সাপেক্ষ বিষয়। আর গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বিশেষ কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। পটুয়াখালী থেকে আমাকে ফাইল বুঝিয়ে দিতে আসতে দেওয়া হয়নি। গত ২২ আগস্ট নির্দেশনা পাওয়ার পর আমি পাঁচদিন ধরে নথিগুলো বুঝিয়ে দেই। যারা ফাইলগুলো বুঝে নিয়েছেন, তাদের জিজ্ঞেস করলে মূল ঘটনা জানতে পারবেন। নথি বুঝিয়ে দিতে সময় নেওয়ার কারণে যদি চাকরিচ্যুত করা হয়, তাহলে দুদকের অনেক কর্মকর্তাই অভিযুক্ত হবেন। এটা দাপ্তরিক প্রক্রিয়া, এটার জন্য চাকরি যাওয়ার কথা নয়।
অভিযোগ— জনৈক ব্যক্তির হুমকি দেওয়ার কথিত অভিযোগে গত ৩০ জানুয়ারি থানায় জিডি করেন শরীফ। বিষয়টি তিনি কাউকে অবহিত করেননি। গণমাধ্যম সূত্রে জেনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাইলে তিনি কোনো সহযোগিতা নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
জবাব— আমি পটুয়াখালী থেকে ছুটি নিয়ে চট্টগ্রামে গিয়েছি। অনুমোদিত ছুটির কাগজ আপনাদের (দুদক) প্রেরণ করেছি। হুমকির বিষয়টি আমি পরিচালককে (প্রশাসন) জানাই। এ বিষয়ে ভয়েস রেকর্ড রয়েছে। তার পরামর্শক্রমে জিডি করি, যা পরবর্তীতে বিভাগীয় পরিচালককে লিখিতভাবে জানাই। এরপর আমার কর্মস্থল পটুয়াখালী অফিসকেও বিষয়টি লিখিতভাবে জানিয়েছি। এরপরও কথিত অভিযোগ বলা হচ্ছে, আমি তো সবকিছু তাদের জানিয়েছি।
অভিযোগ— তিনি রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট প্রদান বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করেছেন। এ ধরনের অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়ে পরিচালকের নেতৃত্বে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ছয় সদস্যের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা হয়। শরীফ উদ্দিন টিমের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিভ্রান্ত করে চলেছেন যে তিনি সব উদঘাটন করেছেন।
শরীফের জবাব— এ বিষয়ে বিভ্রান্তিকর অভিযোগ করা হয়েছে। আমার টিম লিডার জহিরুল ইসলাম বর্তমানে সৌদি আরবে কর্মরত। আমি অনুরোধ করব তার বক্তব্য নেওয়ার জন্য। সেখানে কর্মরত থাকাকালে ২০টি মামলা হয়েছে। যার অধিকাংশের বাদী আমি। আমি দুই জন উপ-পরিচালকসহ কক্সবাজার যাই, সেখানে আমরা চার জনকে গ্রেপ্তার করি। আমাকে বদলির পর একটিও মামলা হয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্পূর্ণ দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করেছি। সেখানে ক্রেডিট নিতেই পারি। সহকর্মীরা আমাকে সহায়তা করেছেন। বড় বড় মামলাগুলো আমাকেই করতে দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ— কক্সবাজার জেলার জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ২০২০ সালের ১৫ মার্চে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের দাখিল করা প্রতিবেদনে দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭ এর বিধি-১০(বি) এর নির্দেশনা অনুসৃত হয়নি। বিশেষ করে প্রতিটি এলএ কেসের বিপরীতে কে, কখন, কীভাবে কি অপরাধ করেছে এবং অপরাধটি সংঘটনের সঙ্গে আসামিদের দায় সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। আসামীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ক্রিমিনাল চার্জ সমর্থনে সাক্ষ্য-প্রমাণ সুস্পষ্ট করা হয়নি।
শরীফের জবাব— এ বিষয়ে এত বড় রিপোর্ট চট্টগ্রাম সজেকায় আর হয়নি। নবীন কর্মকর্তা হিসেবে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকবেই। তাছাড়া ১৫৫ জনকে আসামি করা, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম আসা যাওয়া ও কভিডকালে সবকিছু বিবেচনা করলে এটা পজিটিভ রিপোর্ট দিয়েছি। এতে ভুল-ক্রটি থাকতেই পারে। এখানে কোয়ারি করে আমার কাছে জানতে চাইলেই ভুলগুলো থাকতে না। এটার জন্য ফাঁসির মতো শাস্তি দেওয়া হলে আমি বলব চরম অন্যায় করা হয়েছে।
অভিযোগ— স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, বদলি, নিয়োগ বাণিজ্য, ক্লিনিক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে শরীফের দাখিল করা অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সঙ্গে তদারককারী কর্মকর্তাই দ্বিমত পোষণ করেছেন। বিশেষ করে টেন্ডারে অনিয়ম সংক্রান্তে মালামালের গুণগত মানের তথ্য, জড়িত ব্যক্তিদের সুনির্দিষ্ট সম্পৃক্ততা, মূল্যায়ন কমিটির দায়-দায়িত্ব, আর্থিক বছর, সরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনা। তার প্রতিবেদন কমিশন কর্তৃক বিবেচিত না হওয়ায় দুই সদস্যের অনুসন্ধান টিম গঠন করে পুনরায় অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হয়েছে।
শরীফের জবাব— আমি রিপোর্ট দাখিল করে চলে যাই, তখন ২০২১ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর দুই দিন চট্টগ্রাম অফিসে আসি। ওইদিন আপত্তি দিয়েছে। তারা কীভাবে জানলো, আমার রিপোর্টে অসঙ্গতি আছে, উপ-পরিচালক ও পরিচালকের কাছে রয়েছে কিংবা ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে। আমি অনুরোধ করব আমি সঠিক রিপোর্ট দিয়েছি নাকি আমার পরিচালক মিসগাইড হয়ে রিপোর্ট দিয়েছে? যাচাই করে দেখবেন।
দুদকের অভিযোগ— শরীফ উদ্দিন ২০১৭ সালে কর্ণফুলী গ্যাসের বিভিন্ন অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর কেডিসিএল কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়ে সেখানে তার আপন ছোট ভাই শিহাব উদ্দিন সবুজকে কোনো বিজ্ঞাপন ছাড়াই ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে চাকরি দেন। বর্তমানে তিনি আইটি ডিপার্টমেন্টে কর্মরত আছেন। এছাড়া তিনি সেখানে তার আত্মীয় মুহাম্মদ শাহাব উদ্দিন জাল সনদের মাধ্যমে ড্রাইভার পদেও চাকরি দিয়েছেন, যা বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। নিজের ভাই ছাড়াও নিকটাত্মীয়কে প্রভাব খাটিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
শরীফের জবাব— আমার ছোট ভাই মাস্টার্স করা একটি ছেলে। সে কি চাকরি করতে পারবে না? ২০১৭ সালে একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের আওতায় দুই জন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পায়। যখন নিয়োগ পায় তখন এমডি ছিলেন খায়রুজ্জামান মজুমদার। আমি অনুরোধ করব, তার বক্তব্য নেওয়ার জন্য। কখনও কোনো চাপ দিয়েছি কি না? আর কর্ণফুলী গ্যাসের এমডি আইয়ুব খান চৌধুরী তার দুই ছেলেকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছেন, যা আমার রিপোর্টে উল্লেখ করেছি। সেটা তো স্পষ্ট। আর আমার শাশুড়ি নাম রোকেয়া বেগম। কিন্তু বলা হয়েছে আনোয়ারা বেগম। অবৈধ গ্যাস সংযোগ যদি থেকে থাকে, এতদিন কেন দেখে নাই?
এ বিষয়টি আমার জানা নেই। আমার শ্বশুর বাড়িতে যদি অবৈধ গ্যাস সংযোগ থেকে থাকেও আমি যদি তদবির করে থাকি তার নথি জনসন্মুখে উপস্থাপন করার অনুরোধ করব। আমি শাহাবুদ্দিন নামে কাউকে চিনি না।
পরিশেষে একটি কথা বলব ২০১৪ সালে আমিও সব কর্মকর্তারা সম্পদের হিসাব জমা দেই। ২০২২ সালে এসে কি সম্পদ গড়েছি। আমার বিরুদ্ধে যদি অবৈধ সম্পদের প্রমাণ থেকে থাকে তাহলে তা খতিয়ে দেখবেন। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণের আগেই এভাবে ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া কতটুকু যথার্থ। আমার দুটো বাচ্চা রয়েছে। আমাকে এ সমাজে থাকতে হবে। আমি আপনাদের কাছে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার করা অনুরোধ করছি। আমার আকুতি থাকবে আমাকে একটি সুযোগ দেবেন।
এর আগে ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সই করা এক প্রজ্ঞাপনে মো. শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাকে অপসারণ করার কথা বলা হয়। পরদিন কমিশনের প্রধান কার্যালয়সহ ২১ জেলায় দুদকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ওই বিধি বাতিল এবং অপসারণের আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন করেন।
আরএম/জেডএস/এসএসএইচ