দিনটি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে। তাদের প্রাণের বিনিময়েই অর্জিত হয়েছে মাতৃভাষা বাংলা। ভাষার এই মাসকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমি প্রতিবছরই আয়োজন করে অমর একুশে বইমেলা।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে এমনিতেই ১৫ দিন পিছিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে এবারের একুশে বইমেলা। বইমেলার এই দিনটিতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী অংশে আয়োজিত মেলায় লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল। মেলায় সকালের দিকে কিছুটা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার দিকে মেলার ২ প্রাঙ্গণেই কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় মানুষে।

এদিকে মাতৃভাষা অর্জনের এই দিনটিতে পুরো দেশ গভীরভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছে ভাষা সৈনিকদের। মেলা চত্বর ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ নারীর পরনে ছিল সাদাকালো রঙের শাড়ি, আর ছেলেদের ছিল পাঞ্জাবি। 

প্রযুক্তির এই সময়ে বই মেলায় ছিল সেলফির জোয়ার। তাদের পোশাক এবং সেলফির জায়গাটি দেখে প্রবীণরা আক্ষেপ করে জানিয়ে বলেছেন, নবীনদের আবেগের জায়গাটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। নবীনদের আবেগকে আরও পোক্ত করার জন্য এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। না হলে হয়তো একসময় তাদের আবেগের জায়গাটা একেবারেই ক্ষীণ হয়ে যাবে।

কথা হয় তরুণ সংবাদকর্মী সাদিয়া কানিজের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'আসলে একেক জন একেক রকম ভাবে চিন্তা করে। অনেকেই আছে যারা এই দিনের মর্ম বোঝে না। অথচ ছুটি পেয়েছে বলে ঘুরতে বের হয়। সেই জন্যই ইতিহাস জানাটা জরুরি। এই দিনের তাৎপর্য জানলে হয়তো দিনটা সেলফি বদ্ধ থাকত না। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের বড়দের উচিত, তরুণ প্রজন্মের মাঝে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা ছড়িয়ে দেওয়া।'

হোম ইকোনমিক্স কলেজ শিক্ষার্থী মারিয়া সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'আমাদের মুখের ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদেরকে কখনোই ভুলবার নয়। আমরা অনেক সময় ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে কথা বলি। কিন্তু তাদেরকে সত্যিকার অর্থে শ্রদ্ধা জানাতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই বাংলা ভালোভাবে চর্চা করতে হবে।'

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন শোভন ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'আমাদের অভিভাবকরাই আমাদের ইংরেজির প্রতি ঝুঁকিয়ে দিচ্ছে বেশি। ইংরেজি ভালো না জানলে নাকি পুরো পৃথিবীর আয়ত্ত করা যাবে না। তাই ছোট থেকে বাংলার চেয়ে ইংরেজিকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে অভিভাবকরা। আর এটার জন্য অভিভাবকরাই দায়ী। একুশকে আমাদের চর্চার মধ্যে রাখতে হবে। না হলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো এটাকে শুধুমাত্র একদিনের উৎসবই মনে করবে।'

এদিকে ষাটোর্ধ্ব সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের কর্মকর্তা তারিকুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'তরুণদের আবেগ এখন বাহ্যিক হয়ে গেছে। আগে আমরা ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে বিভিন্ন সংকলন বের করতাম, রাত জেগে শহীদ মিনার তৈরি করতাম। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে সেই জিনিসগুলো দেখা যায় না। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন পোশাকি উৎসবে পরিণত হয়েছে। একটা জিনিস মানুষ সহজেই পেলে যেমন তার মূল্য থাকে না, বর্তমানে তরুণদের কাছে ভাষাটা তেমনি হয়ে গেছে। একুশের চেতনা গভীরভাবে তাদের মনে ছড়িয়ে দিতে আমাদের এখনই দায়িত্ব নিতে হবে।'

চল্লিশোর্ধ্ব একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এমদাদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'একুশকে আমরা আগে যেভাবে স্মরণ করতাম, নতুনরা সেটা করতে পারেনি। নতুনদের ভেতরে একুশের আবেগটা আরও পোক্ত করে দেওয়া উচিত। একুশে ফেব্রুয়ারি একটা অর্জন। অর্জন থাকলে উৎসব থাকবে। তবে সেটা কিভাবে স্মরণ করতে হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।'

মেলায় লোক সমাগম 

একুশে ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় প্রতিবছর যেমনটা ভিড় লেগে থাকে মানুষের, আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। মেলার আয়তন বৃদ্ধি করায় মানুষের ধারণ ক্ষমতা ছিলো অন্যান্যবারের থেকে বেশি। তারপরও কোন জায়গা খালি ছিল না। বই কিনতে আসুক বা না আসুক মেলায় প্রচুর ভিড় ছিল নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরদের। আর এতে অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন প্রকাশকরা।

সেলফি 

মেলায় আগত মানুষের মাঝে বই দেখা বা কেনার চেয়ে সেলফি তোলার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গিয়েছে। মেলায় যিনি অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য প্রবেশ করেছেন তিনিও কোন বড় প্রকাশনীর সামনে দাঁড়িয়ে একটি সেলফি তুলেছেন। আর সেলফি তোলার ক্ষেত্রে শুধু তরুণরাই নয়, মাঝবয়সীরাও বাদ ছিলেন না।

মেলায় বিক্রি 

গত শুক্রবারই প্রকাশকেরা আশা করেছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে মূল বইমেলা শুরু হবে। তার ধারাবাহিকতায় আজ খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, সব প্রকাশক প্রায় খুশি। তারা জানিয়েছেন মেলায় যে পরিমাণ লোক এসেছে সে পরিমাণ বিক্রি হয়নি। কিন্তু, বিক্রি বেশ ভালো হচ্ছে।

এমএইচএন/