ফুলে ফুলে ভরে গেছে শহীদ মিনার। অজস্র মানুষের জমায়েতে মুখরিত প্রাঙ্গণ। খালি পায়ে ফুল হাতে শহীদ মিনারের বেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদ বীর সেনানীদের স্মরণ করছে সমগ্র জাতি। তবে যার হাতের পরশে রূপ পেয়েছে এই শহীদ মিনার তাকে কতটুকু মনে করা হচ্ছে আজকের এই দিনে? 

বলছিলাম শহীদ মিনারের স্থপতি শিল্পী হামিদুর রহমানের কথা। প্রখ্যাত হামিদুর রহমান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিমাখা শহীদ মিনারের নকশা করেছেন। তাকে বলা হয় শহীদ মিনারের স্থপতি। অনন্য এই স্থাপনার স্রষ্টা হিসেবে ১৯৮০ সালে তিনি লাভ করেন একুশে পদক। তবে আজকের এই বিশেষ দিনে তাকে কেন্দ্র করে নেই কোনো আয়োজন অথবা তার কবরে নেই তেমন শ্রদ্ধাঞ্জলিও।

সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর আজিমপুরের পুরাতন কবরস্থানে তার কবর ঘুরে দেখা যায়, সবে মাত্র দুটি ফুলেল শ্রদ্ধা। তার পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত ভাষা শহীদ আবুল বরকত, আ. জব্বার ও শফিউর রহমানের কবরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের  শ্রদ্ধাঞ্জলি থাকলেও তার কবরটি পড়ে আছে ফাঁকা।

এনিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই আগত দর্শনার্থীদেরও। সিরাজুল ইসলাম নামে এক দর্শনার্থী বলেন, আমরা বইপত্রে পড়েছি শহীদ মিনারের স্থপতি হামিদুর রহমানের কথা। কিন্তু তার সম্পর্কে তেমন কোনো সমৃদ্ধ ইতিহাস জানা নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবেই নতুন প্রজন্মের কাছে তাকে পরিচিত করানো উচিত। নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেন না শহীদ মিনারের স্থপতির পূর্ণ পরিচয়।

হাসান ইকবাল নামে আরেক দর্শনার্থী বলেন, এখানে ভাষা শহীদদের কবর দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু আসার পর দেখতে পেলাম শহীদ মিনারের স্থপতির কবরও এখানেই। এটি আমি জানতাম না। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, শহীদ মিনার, পতাকা, মানচিত্র এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো সম্পর্কে আমাদের আরও বেশি জানা দরকার।  

জানা যার, ১৯২৮ সালে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে হামিদুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। বংশগতভাবেই তিনি ছিলেন বনেদি পরিবারের সন্তান। তার বাবার নাম মির্জা ফকির মোহাম্মদ ও মাতা জমিলা খাতুন। তার মেজ ভাই নাজির আহমেদ ছিলেন পূর্ববঙ্গের চলচ্চিত্র বিকাশের উদ্যোক্তা। ছোট ভাই সাঈদ আহমেদ ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব ও লেখক। ঢাকার শেষ বাইশ পঞ্চায়েতের নেতা ছিলেন তার চাচা আব্দুল কাদের সরদার। হামিদুর রহমানকে শহীদ মিনারের নকশা করার কাজ দেওয়ার পর থেকেই তিনি ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্রীয়ভাবে ধারণ করে এমন একটি নকশা করতে চেয়েছিলেন।

অনেভৌমিক উলম্ব আকারের কাঠামোর মাধ্যমে পুরো বাঙালির পরিচয়কে বের করে আনতে চেয়েছিলেন তিনি। সেজন্য কেন্দ্রীয় কাঠামোর উভয় দিকে চারটি স্তম্ভের মাধ্যমে একত্রিত স্তম্ভের ভারসাম্য এবং সাদৃশ্য রক্ষার ব্যবস্থা করেন। প্রকৃত নকশাতে তিনি স্টেইনড কাঁচের মধ্যে হাজার ও চোখের মতো গঠন ও এঁকেছিলেন। যার মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো এসে সামনের মর্মরখচিত মেঝেকে ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত আলোকিত করে রাখবে। এরপর তাঁর রূপকল্পনা অনুসারে ১৯৬২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কিছুটা পরিবর্তিত আকারে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয়। যা পরবর্তী বছর ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করা হয়।

তবে খ্যাতনামা শিল্পী নভেরা আহমেদ এই নকশায় হামিদুর রহমানকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন। কিন্তু সরকারিভাবে তার নাম না থাকায় শহীদ মিনারের নকশায় হামিদুর রহমানের সঙ্গে তার অবদান নিয়ে বিতর্কও রয়েছে।

এছাড়াও হামিদুর রহমান আরও বেশ কিছু নান্দনিক চিত্রকর্ম অংকন করেন। তিনি ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেম্বর কানাডার মন্ট্রিলে মৃত্যুবরণ করেন।

শিল্পচর্চায় অবদানের ফলে হামিদুর রহমান দেশে-বিদেশে পুরস্কৃত ও সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৭২ সালে মাদার অ্যান্ড স্মোক চিত্রের জন্য তিনি ‘ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব বাংলাদেশী পেইন্টার্স’ থেকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তার ফ্লাওয়ার ইন মাই বডি চিত্র ইরানের ‘৫ম তেহরান দ্বিবার্ষিক’-এ প্রথম পুরস্কার লাভ করে। কমনওয়েলথ পেইন্টার্স এক্সিবিশনে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার হিসেবে সম্মানিত হয় তার অঙ্কিত বোট। ১৯৬২ সালে তার সানফ্লাওয়ার চিত্রটি পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডিতে ‘ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব পেইন্টিংস অ্যান্ড স্কালপচার্স’-এ শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে ‘প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড অব প্রাইড অব পারফরমেন্স ফর পেইন্টিং’ পদক দিলেও হামিদুর রহমান কর্তৃক প্রত্যাখাত হয়।

চিত্রশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর হামিদুর রহমানের পরিবার থেকে তার নামাঙ্কিত হামিদুর রহমান পুরস্কার দেওয়া হয়। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এ পুরস্কার দেওয়া দায়িত্বে থাকেন।

আরএইচটি/এসএম