প্রতীকী ছবি।

নরসিংদীর মনোহরদীতে অপহরণের পর মুক্তিপণ না পেয়ে মিঠু হোসেন (২৪) নামের এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। 

রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ির মিঠালু গ্রামে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারকৃত নারীর ভাষ্যমতে, ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি ওই যুবককে নরসিংদীতে ডেকে এনেছিলেন। 

গ্রেপ্তার নারীর নাম শাহানাজ আক্তার ওরফে পপি (২৮)। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ি এলাকার গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে তিনি। দুই সন্তানের জননী ওই নারী শ্রীপুরের রাজাবাড়ি এলাকার একটি কম্পোজিট কারখানায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। তিনি ফেসবুকে কমবয়সী সুশ্রী নারীর ছবি প্রোফাইল পিকচার হিসেবে ব্যবহার করে মিঠুর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলতেন।

এর সত্যতা নিশ্চিত করে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাহেব আলী পাঠান জানান, বাবুরহাটের শাড়ি সম্পর্কে ধারণা নিতে গত বুধবার প্রথমবারের মতো নরসিংদীতে আসার কথা তার পরিবারের সদস্যরা জানলেও আসলে মিঠু এসেছিলেন ওই নারীর প্রলোভনে। নির্দিষ্ট স্থানে আসার পরই তাকে অপহরণ করে আটকে রেখে এক লাখ টাকা মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে তার মৃত্যু হলে লাশ মনোহরদীর একদুয়ারিয়া ইউনিয়নের হুগলিয়াপাড়া গ্রামের রূপচানের বাড়ির খড়ের গাদার নিচে ফেলে রাখা হয়।এরপর গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে মিঠু হোসেনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত মিঠুর পিঠে, গলায় ও চোখের নিচে রক্তাক্ত জখম ছিল। এ ছাড়া তার শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন ছিল।

পরে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ দেখে ওই রাতেই সিরাজগঞ্জ থেকে মিঠু হোসেনের পরিবারের সদস্যরা মনোহরদী থানায় আসেন। রাত ১২টার দিকে পুলিশের কাছে থাকা ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করেন মিঠুর বড় বোন মিনু আক্তার। অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে ওই রাতেই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন নিহত ব্যক্তির বড় বোন মিনু আক্তার।

নিহত মিঠু হোসেন সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার রায়পুর এলাকার মৃত মোসলেম উদ্দিনের ছেলে। তিনি সিরাজগঞ্জের একটি ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজের বিএ প্রথম বর্ষে পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে শাড়ির ব্যবসা করতেন।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, মিঠুর ফোনকলের সিডিআর সংগ্রহ করে আমরা জানতে পারি, সিরাজগঞ্জ থেকে রওনা হয়ে নরসিংদী আসার পথে শাহানাজ আক্তার ওরফে পপি নামের ওই নারীর সঙ্গে তার অনেকবার কথোপকথন হয়। এর সূত্র ধরে আজ (রোববার) সকালে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই নারীকে আটক করি আমরা। আটকের পর মিঠুর সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ঘটনার বিস্তারিত আমাদের জানান। অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় করে এমন একটি চক্রের সদস্য তিনি। এই শাহানাজ আক্তারই মিঠুকে নরসিংদীতে আসতে বলেছিলেন। পরে তাকে শিবপুরের দুলালপুরের আশুটিয়া পূর্বপাড়ার একটি গোপন স্থানে আটকে রেখে নির্যাতনের পর এক লাখ টাকা মুক্তিপন চান। মুক্তিপণের টাকা দিতে ব্যর্থ হলে মিঠুকে হত্যা করে লাশ পার্শ্ববর্তী মনোহরদীর একদুয়ারিয়া ইউনিয়নের হুগলিয়াপাড়া গ্রামের রূপচানের বাড়ির খড়ের গাদার নিচে ফেলে রাখা হয়। মিঠুকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে পরে তাকে এই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই চক্রের মূলহোতাসহ সকলকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

গ্রেপ্তার শাহানা সরকার ওরফে পপির ভাষ্য, গত ৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে আমার মুঠোফোনে কল করে দেখা করতে চান সিফাত নামের এক ব্যক্তি। পরে ৭ তারিখে তিনি শ্রীপুরে এসে দেখা করে আমার হাতে তিন হাজার টাকা দিয়ে বলেন, একটা কাজ করে দিলে আরও ১০ হাজার টাকা দেব। কী কাজ জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজনের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে তাকে নরসিংদী নিয়ে আসতে হবে। আমার কী হয়েছিল জানি না, আমি টাকার লোভে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। সিফাতের সঙ্গে এই পর্যন্ত আমার দুইবার কথা হয়েছে। পরে জানতে পারি সিফাতদের কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপ আছে, যেখানে পর্ণো ভিডিও ছাড়া হয়। তাদেরই একটি গ্রুপে নক দিয়েছিল মিঠু হোসেন। গ্রুপের মেসেঞ্জার চ্যাটে মিঠুর সঙ্গে কথা বলত তারা। কিন্তু মোবাইলে কথা বলতাম আমি। আমি মিঠুকে সুমন নামে আর হানিফকে সিফাত নামে চিনতাম। পরে আমি মিঠুকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে একসঙ্গে তিনদিন থাকার প্রস্তাব দিলে রাজি হয়ে যায়। 

কথাবার্তার একপর্যায়ে গত বুধবার সকালে আমার সঙ্গে তিনদিন থাকার জন্যই সিরাজগঞ্জ থেকে নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হয় মিঠু। সিফাতের কাছ থেকে ঠিকানা জেনে নিয়ে আমি মিঠুকে বলেছিলাম নরসিংদীর শিবপুরের দুলালপুর এলাকার আশুটিয়াপাড়ায় চলে আসতে। আমি শ্রীপুরে থেকেই তার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে থাকি। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ওই এলাকায় যাওয়ার পর তার সঙ্গে যখন আমার সর্বশেষ কথা হয়, সে আমাকে বলেছিল- আমি তোমার দেওয়া ঠিকানায় চলে এসেছি। এরপরই আমি সিফাতের মোবাইলে কল করি, কল ধরে সিফাত জানায়- সে চলে আসছে। আমাকে পরে কল দেবে জানিয়ে তিনি কল কেটে দেন। এরপর তার মুঠোফোন বন্ধ থাকায় আর আমাদের কথা হয়নি। 

তিনি আরও জানান, ১০ হাজার টাকার লোভে আমি শুধু মিঠুকে কৌশলে নরসিংদীতে এনে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এছাড়া সিফাতের আরেক নাম যে হানিফ, এটা আমি জানতাম না। শুধু জানতাম, তার বাড়ি নরসিংদীর শিবপুরের আশুটিয়াপাড়ায়। মিঠুকে কী কারণে নরসিংদীতে আনা হয়েছে তাও জানতাম না। পরে জেনেছি তাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতে চেয়েছিল তারা। পরে মুক্তিপণ না পেয়ে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে সিফাতরা। গতকাল (শনিবার) সন্ধ্যায় সিফাত আমাকে অন্য একটি মুঠোফোন নাম্বার থেকে কল দিয়ে বলে, সাবধানে থাইকো। কারণ হিসেবে বলে, মিঠু মারা গেছে। আজ ভোরে যখন আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে আসে, তারপর পুরো ঘটনা জানতে পারি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিঠুর বাবা ছয় মাস আগে মারা গেছেন। তার মা দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত। বাবার মৃত্যুর পর থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে শাড়ির ব্যবসা করে সংসার চালাতেন মিঠু। স্থানীয় বিভিন্ন হাট থেকে শাড়ি সংগ্রহ করে অনলাইনে বিক্রি করলেও, নরসিংদীর বাবুরহাটের কাপড় বিক্রির ইচ্ছা ছিল তার। এজন্য গত বুধবার সকালে সিরাজগঞ্জ থেকে নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন। ঢাকায় পৌঁছার পর তিনি এক আত্মীয়ের বাড়িতে দুপুরের খাবার খান। পরে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নরসিংদী পৌঁছে পরিবারের সদস্যদের কাছে কল করে ঠিকঠাক পৌঁছানোর খবর জানান। তবে নরসিংদীতে ঠিক কাদের কাছে তিনি গিয়েছিলেন, তা কেউ জানতেন না।

নিহতের পরিবারের ভাষ্য, ফেসবুকে পরিচয় হওয়া দুই বন্ধুর ভরসায় গত বুধবার সন্ধ্যায় নরসিংদীতে আসার পর অপহরণের শিকার হন তিনি। ওইদিন রাত প্রায় ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত অন্তত ৫০ বার মিঠুর মুঠোফোন থেকে কল করে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ চান তারা। হত্যাকাণ্ডের পরদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে যখন পুলিশ মিঠুর লাশ উদ্ধার করছিল তখনও মুক্তিপণের টাকা চেয়েছিল অপহরণকারীরা।

জানতে চাইলে নরসিংদী পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম জানান, গ্রেপ্তার শাহনাজ আক্তার পপির নেতৃত্বে আরও তিন/চারজনের একটি প্রতারক চক্র রয়েছে। তিনি ফেসবুকে নিজের প্রকৃত পরিচয় গোপন করে সুন্দরী মেয়ের ছবি ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে দেখা করতে বলতেন। পরে ওই চক্রের অন্য সদস্যরা তাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করত। মিঠুকে এভাবেই ফাঁদে ফেলে নরসিংদীতে ডেকে আনা হয়েছিল। এই ঘটনায় জড়িত চক্রটির অন্য সদস্যদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।  

রাকিবুল ইসলাম/এইচকে