অগোছালো রেখে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বইমেলা
আজ মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) উদ্বোধন হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। করোনাকালে বিশেষ পরিস্থিতিতে ১ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে ১৪দিন পিছিয়ে আজ দ্বার খুলতে যাচ্ছে ভাষার মাসের প্রাণের মেলা। মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় সরেজমিন দেখা যায়, ক্রেতা-দর্শনার্থীদের জন্য এখনও তৈরি হয়নি মেলা প্রাঙ্গণ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলা প্রাঙ্গণ-জুড়ে এখনও অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ স্টল বা প্যাভিলিয়নের কাঠামো তৈরির কাজ চলছে। শুধু তাই নয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের মেলার মাঠে তৈরি হয়নি ইটের পথ। লিটলম্যাগ চত্বরও পুরোটাই ফাঁকা। বলা চলে অনেকটা অগোছালো ও অপ্রস্তুত রেখে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে এবারের বইমেলা।
বিজ্ঞাপন
মেলায় অংশ নেওয়া প্রকাশকদের দাবি, মেলা শুরুর আগের দিন এমন পরিস্থিতি গত ২০ বছরে দেখা যায়নি। মেলার ব্যাপ্তি ১৪ দিন হওয়ায় অনেক ছোট প্রকাশক এবারের মেলা নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। উদ্বোধনের কয়েক ঘণ্টা বাকি থাকলে অনেক প্রকাশক স্টল তৈরি কাজে মনোযোগী নয়।
প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম বলেন, এবারের মেলা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু না হয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে। এত সময় পাওয়ার পরও প্রস্তুতি হয়নি মেলা প্রাঙ্গণ। উদ্যান অংশে সীমানা বেঁধে দেওয়ার কাজটিও অসম্পন্ন রয়ে গেছে। এরআগে কখনও এতটা অগোছালো-ভাবে মেলা শুরু হয়নি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা প্রাঙ্গণে আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গণী বলেন, মেলার শুরু হওয়ার আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। কিন্তু এখনও মেলার অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ স্টল ও প্যাভিলিয়ন তৈরির কাজ শেষ হয়নি। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে প্রবেশ পথে বসানো হয়নি ইট। এখনও বাকি আছে সীমানা প্রাচীর দেওয়ার কাজও। ফলে, এ রকম অস্পূর্ণকাজ রেখে আগে কখনও মেলার উদ্বোধন হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে নিবেদিত দুই সপ্তাহব্যাপী অমর একুশে বইমেলা ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকেল তিনটায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ২০২১ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাশিল্পী, কবি ও গবেষকদের আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার দেওয়া হবে। এবারের মেলার প্রতিপাদ্য ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’।
করোনাজনিত পরিস্থিতির কারণে এক মাসের পরিবর্তে এবার দুই সপ্তাহব্যাপী চলবে মেলা। সে অনুযায়ী ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে মেলা। তবে, সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি হলে বাড়তে পারে মেলার মেয়াদ। আয়ু কমলেও এবার বাড়ছে মেলার সময়। প্রতিবছর মেলা বিকেল ৩টা থেকে শুরু হলেও এবার শুরু হবে এক ঘণ্টা আগে অর্থাৎ ২টা থেকে। চলবে রাত নয়টা পর্যন্ত। তাই ছুটির দিন বাদে সাধারণ দিনে ৬ ঘণ্টার পরিবর্তে এবার ৭ ঘণ্টা চলবে বাঙালির সবচেয়ে বড় এ সাংস্কৃতিক উৎসব।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যাতে না ছড়ায় সে কারণে মেলায় কঠোরভাবে মানতে স্বাস্থ্যবিধি। মেলায় প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। মাপা হবে শরীরের তাপমাত্রা। মেলায় প্রবেশের আগে দর্শনার্থীদের স্যানিটাইজ করা হবে। আর মেলা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, স্টলের মালিক ও কর্মীদের করোনার টিকার সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে, সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য মেলায় প্রবেশে টিকার সনদ না লাগলেও ফুডকোটে বসে খেতে হলে দেখাতে হবে ভ্যাকসিন কার্ড।
সোমবার বাংলা একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে মেলার সময় (দিন) বাড়তে পারে জানিয়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, করোনা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সময় বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সংক্রমণের কমে গেলে মেলার মেয়াদ বাড়বে। তবে, কঠোরভাবে মানা হবে স্বাস্থ্যবিধি। মাস্ক ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না বইমেলায়।
আজ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলা একাডেমি আঙ্গিনা এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৭ লাখ বর্গফুট জায়গা-জুড়ে অনুষ্ঠিত হবে ২০২২ সালের অমর একুশে বইমেলা। অংশ নিচ্ছে ৫৩৪টি প্রতিষ্ঠান। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০২টি প্রতিষ্ঠানকে ১৪২টি ইউনিট এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩২টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৩৪টি ইউনিট দেওয়া হয়েছে। মোট ৫৩৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৭৬টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এবারই মেলায় সর্বোচ্চসংখ্যক ৩৫টি প্রকাশনা সংস্থার প্যাভিলিয়ন থাকবে। বইমেলায় বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। এবারও শিশুচত্বর মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে থাকবে। তবে কোভিড পরিস্থিতির কারণে এবার প্রথমদিকে ‘শিশু-প্রহর’ থাকবে না।
প্রতিবছর মতো এবারও মেলায় থাকছে গ্রন্থ উন্মোচন, লেখক বলছি মঞ্চ, নতুন বইয়ের স্টল, শিশু চত্বর, পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, পর্যাপ্ত প্রবেশ ও বাইর হওয়ার পথ, আশ্রয় কেন্দ্র, পার্কিং ব্যবস্থা, ব্রেস্ট ফিডিং জোন, নামাজের ঘর, টয়লেট ব্যবস্থা, হুইল চেয়ার, ফুডকোট ইত্যাদি। এছাড়া এবার মেলায় কিছু নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। মেলার অঙ্গসজ্জায় বিশেষভাবে মেলে ধরা মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও স্বাধীনতার মর্মবাণী সবার মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু-গ্রন্থভুক্ত হস্তলিপি বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যবহার করা হয়েছে। লিপি পাঠ করে তরুণেরা বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখার সঙ্গে পরিচিত হবে।
বইমেলার মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪টি প্রবেশ ও ৩টি বের হওয়ার পথ থাকবে। বিশেষ দিনগুলোতে লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক, বাংলা একাডেমির ফেলো এবং রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত নাগরিকদের জন্য প্রবেশের বিশেষ ব্যবস্থা করা হবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে উপজীব্য করে প্রতিদিন বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০২২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং ২০২২ সালের বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা বই প্রকাশের জন্য ৩টি প্রতিষ্ঠানকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হবে।
এছাড়া ২০২২ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য ১টি প্রতিষ্ঠানকে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার এবং এ বছরের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে। এবারের বইমেলায় বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে নতুন ও পুনর্মুদ্রিত ১০৭টি বই।
বইমেলার প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে পর্যাপ্তসংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। মেলা এলাকাজুড়ে তিন শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে বইমেলা। তবে রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না। ছুটির দিন অর্থাৎ শুক্র ও শনিবার বইমেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। ২১ ফেব্রুয়ারি মেলা শুরু হবে সকাল ৮টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
এএইচআর/এসএম