দুদকের ২ মামলা
কর্ণফুলী গ্যাসের বড়কর্তার ঠিকাদার রূপে লুটপাট!
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিএসএল) বড় পদে চাকরি করলেও আড়ালে থেকে স্ত্রীসহ কয়েকজনের নাম ব্যবহার করে খোলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চাকরির আড়ালে ঠিকাদারি কাজ করে চালান লুটপাট।
তিনি কেজিডিএসএলের সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ও মেসার্স রক প্রপার্টিজের পরিচালক মো. আনিছ উদ্দিন আহমেদ ওরফে শামীম। চাকরিরত অবস্থায় নিজ প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়াসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।
বিজ্ঞাপন
মেসার্স রক প্রপার্টিজের ছদ্মাবরণে তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রায় ছয় লাখ টাকা আত্মসাৎ এবং প্রায় ১০ কোটি টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ মিলেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে। শুধু তাই নয়, আনিছ উদ্দিনের বিরুদ্ধে এক কোটি ৮৫ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণও পেয়েছে সংস্থাটি।
এ কারণে কেজিডিএসএলের সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক ও তার স্ত্রীসহ চারজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা ও আনিছ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের আরেকটি মামলা করেছে দুদক। সংস্থাটির উপ-পরিচালক মো. জাহিদ কালাম বাদী হয়ে সংস্থাটির চট্টগ্রামের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা দুটি দায়ের করেন। সোমবার দুদকের জনসংযোগ দফতর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থ আত্মসাৎ ও সন্দেহজনক লেনদেনের মামলার আসামিরা হলেন, মো. আনিছ উদ্দিন আহমেদ ওরফে শামীম, তার স্ত্রী ও মেসার্স রক প্রপার্টিজের চেয়ারম্যান কামরুন নাহার ওরফে পলি, মেসার্স রক প্রপার্টিজ ও মেসার্স মেটকো কন্সট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নেছার আহমদ এবং নিবন্ধিত ঠিকাদার ও মেসার্স নুর সিন্ডিকেটের স্বত্বাধিকারী নুর মোহাম্মদ।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬ এর ৬৪(৩) ও ৬৩(৪) ধারা লঙ্ঘন করে নুর সিন্ডিকেট নামীয় প্রতিষ্ঠানের আড়ালে রক প্রপার্টিজ নামের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ পাইয়ে দেয়। এভাবে পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫৩ টাকা আত্মসাৎসহ তাদের যৌথ ব্যাংক হিসাবে নয় কোটি ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করে আসামিরা।
ঘটনার বিবরণে বলা হয়, ২০১১ সালের ২১ আগস্ট কর্ণফুলী গ্যাসের তৎকালীন ব্যবস্থাপক (পুর-নির্মাণ) আনিছ উদ্দিন সরকারি কর্মচারী হয়েও সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে কর্ণফুলী গ্যাসের নিবন্ধিত ঠিকাদার মেসার্স মেটকো কন্সট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী নেছার আহমদ এবং স্ত্রী কামরুন নাহারকে নিয়ে ‘রক প্রপার্টিজ’ নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মেসার্স নুর সিন্ডিকেটের সঙ্গে দরপত্র পরিচালনা ও নির্মাণকাজের চুক্তি করেন। চুক্তিতে উল্লেখ ছিল যে, কর্ণফুলী গ্যাসের চাঁদগাওস্থ আবাসিক এলাকায় একটি দশতলা ভবনের দরপত্রে অংশগ্রহণ ও নির্মাণকাজের বিল বাবদ প্রাপ্ত অর্থ থেকে নুর সিন্ডিকেটকে দেড় শতাংশ কমিশন দেওয়া হবে। কাজ শেষে চুক্তিমতো নিজের দেড় শতাংশ হারে কমিশন রেখে বাকি টাকা আনিছ আহমেদের মালকানাধীন প্রতিষ্ঠান রক প্রপার্টিজের ব্যাংক হিসাবে হস্তান্তর করা হয়।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ঠিকাদার নিয়োগের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ জন্য ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টেবার পর্যন্ত তিনটি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা এবং সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
একই বছরের ১২ নভেম্বর দরপ্রস্তাব গৃহীত হলে দেখা যায়, ফোর স্টার সিন্ডিকেট নামে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। তাদের কাগজপত্র ঠিক না থাকায় সেটি বাতিল হয় ও পরবর্তীতে ২৮ অক্টোবর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনটি পত্রিকায় পুনরায় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়।
ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে মেসার্স নুর সিন্ডিকেটেকে নির্বাচন করে কার্যাদেশ প্রদানের সুপারিশ করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর কার্য সম্পাদনের জন্য নুর সিন্ডিকেটের পক্ষে নুর মোহাম্মদ ও মেসার্স রক প্রপার্টিজের পক্ষে পরিচালক নেছার আহমদ চুক্তিপত্র সই করেন।
অনুসন্ধানে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আনিছ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী কামরুন নাহার কর্তৃক যেসব ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে, সেগুলোতে আয়ের উৎস হিসেবে স্বামীর আয় এবং পেশা গৃহিণী উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর ঢাকা ব্যাংকের চট্টগ্রাম সিডিএ এভিনিউ শাখায় আনিছ উদ্দিন, কামরুন নাহার ও নেছার আহমদের নামে রক প্রপার্টিজ নামীয় একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। ওই হিসাবের মাধ্যমে ২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ৪ কোটি ৯৫ লাখ ৭৮ হাজার ৭১৫ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করা হয়। বর্তমানে কামরুন নাহারের ছয়টি ব্যাংক হিসাবে মোট এক কোটি ৭৫ লাখ ৮৪ হাজার ৯৪৪ টাকার রয়েছে, যা অবরুদ্ধকরণের (ফ্রিজ) প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
এছাড়া আনিছ উদ্দিন ও নেছার আহমদের একটি যৌথ হিসাবে নয় লাখ ৩৫ হাজার টাকা জমা করে উত্তোলন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আসামিদের সর্বমোট নয় কোটি ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। আর অসৎ উপায় কাজ পাইয়ে দিয়ে পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫৩ টাকা আত্মসাত করে আনিছ উদ্দিন সিন্ডিকেট। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ধারাসহ ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
দ্বিতীয় মামলায় কেজিডিএসএলের সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক ও মেসার্স রক প্রপার্টিজের পরিচালক মো. আনিছ উদ্দিন আহমেদ ওরফে শামীম এবং তার স্ত্রী ও একই প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান কামরুন নাহার ওরফে পলির বিরুদ্ধে এক কোটি ৮৫ লাখ ৮৪ হাজার ৯৪৪ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
আরএম/আরএইচ