রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর থেকে দূরপাল্লার বাসে ওঠা চিকিৎসকসহ যাত্রীদের নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত আট ডাকাত সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। বিষয়টি সম্পর্কে জানাতে সোমবার সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার কে এম হাফিজ আক্তার জানান, চক্রটি ভাড়া বাসে করে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করত। 

ডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতাররা হলেন নাঈমুর রহমান নাঈম, আবু জাফর বিপ্লব, সজিব মিয়া, জহুরুল ইসলাম, আলামিন, দিলিপ সোহেল, আলামিন ও শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া আজাদ। রোববার রাতে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত চারটি চাপাতি, চারটি ছুরি, পাঁচটি লোহার রড, চোখ বাঁধার কাজে ব্যবহৃত তিনটি গামছা, মোবাইল ১০টি, খেলনা পিস্তল দুটি ও নগদ ৯ হাজার ৮০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। 

এছাড়াও আরেকটি ডাকাতদলের ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপির ডিবি তেজগাঁও বিভাগ। গ্রেফতাররা হলেন মোজাম্মেল হোসেন আপেল, জাহাঙ্গীর আলম, জমির খান, মজিবর রহমান মজিদ, মাসুম গাজী, শফিকুল খরাদি, কুদ্দুস আলী ও কাউছার মিয়া। তাদের কাছ থেকে ডিবির নকল জ্যাকেট, একটি দুনালা বন্দুক, একটি ওয়্যারলেস সেট, একটি হ্যান্ডকাফ, ছুরি ও একটি মাইক্রোবাস জব্দ করা হয়েছে।

অতিরিক্ত কমিশনার কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, চলতি মাসের গত ২০ জানুয়ারি দিবাগত রাতে টাঙ্গাইলের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) শফিকুল ইসলাম তার বন্ধুসহ উত্তরা পশ্চিম থানার আব্দুল্লাহপুর পেট্রোল পাম্পের সামনে থেকে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে আর কে আর পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। বাসে ওঠা মাত্রই ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাকে দুই হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা নগদ এক লাখ ১৫ হাজার টাকা, বিকাশে থাকা পাঁচ হাজার টাকা ও ব্যাগে থাকা দুটি ব্যাংকের এটিএম কার্ড দিয়ে আরও এক লাখ ৫০ হাজার টাকাসহ মোবাইল ফোন ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেন ডাকাতরা।

তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়,  ডাকাতদলটি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আর কে আর পরিবহনের একটি বাস ভাড়ার কথা বলে সাভারের গেন্ডা এলাকায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে ডাকাতরা প্রথমে বাসের ড্রাইভার ও হেলপারকে জিম্মি করে বাসটির নিয়ন্ত্রণ নেন। পরে বাসটি নিয়ে ঢাকা মহানগর এলাকার বিভিন্ন সড়কে ঘুরতে থাকে। আর টার্গেট করে যাত্রী উঠিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাত-মুখ বেঁধে সঙ্গে থাকা নগদ টাকা, মোবাইল ফোন ও মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে তাদের নির্জন স্থানে নামিয়ে দেয়। চক্রটি ঢাকার সাভার, টাঙ্গাইল ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে একইভাবে ডাকাতি করে। ডাকাতদের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়া বাস ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে ডাকাতরা নিজেদের সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন

আরেকটি ডাকাতদলের সদস্যরা

অভিযোগ রয়েছে, ওই চিকিৎসক ডাকাতির ঘটনার পর বিভিন্ন থানায় ঘুরেছেন মামলা করতে। কিন্তু তিনি প্রথমে কোনো আইনি সহায়তা পাননি। ডাকাতির ঘটনার পর ভুক্তভোগী কিভাবে আইনি সহায়তা নিতে পারেন— এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, বাসে ডাকাতির ক্ষেত্রে চলার পথ থেকে শুরু করে বাসটি যে এলাকা দিয়ে যাবে এবং বাসটি যে এলাকায় যাত্রা শেষ করবে সেসব এলাকার যেকোনো থানায় ভুক্তভোগীরা মামলা করতে পারবেন। এই ঘটনায় মামলা নেওয়ার গড়িমসি সম্পর্কে আমরা জেনেছি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। যেকোনো ঘটনা ঘটলেই অভিযোগ করতে নিতে হবে । না হলে আমরা অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনতে পারব না। আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে বিষয়টি জেনে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছি। এরপরই গ্রেফতারদের একাধিক ডাকাতির ঘটনায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। এছাড়া ওই চিকিৎসক রোববার উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করে গেছেন। তিনি যেহেতু উত্তরা থেকে উঠেছেন, সেজন্য উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলাটি করেছেন। মামলা না হলে আমাদের জন্য ক্ষতিকর।  যেসব থানা প্রাথমিকভাবে মামলা নিতে চায়নি, তারা হয়তো চিন্তা করেছে বাসটি কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে গ্রেফতার করবে এসব বিষয়। তবে এটা ঠিক কাজ হয়নি। এ বিষয়ে সেসব থানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ‌

ডাকাতির মামলা বেশি হয়ে গেলে ডিএমপির পক্ষ থেকে ওই সংশ্লিষ্ট থানার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এমন কোনো নির্দেশনা আছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন কোনো চাপ ডিএমপির পক্ষ থেকে নেই। যেকোনো ঘটনার মামলা থানাকে অবশ্যই নিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় ডাকাতির মামলা নিয়ে অনেক কাজ করতে হয়, সে ক্ষেত্রে অনেক থানা মামলা নিতে অনীহা প্রকাশ করে। কিন্তু এই বিষয়ে শক্তভাবে বলা হয়েছে মামলা নিতে, না হলে ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাবে। আরও বলা আছে সম্পত্তি বিষয়ক যে কোন অপরাধের অভিযোগ নিতে হবে।

মামলা না নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ডাকাতির ঘটনার ভুক্তভোগীদের থানা থেকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়। আর যেসব থানা মামলা নিতে অনীহা প্রকাশ করে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডাকাতি মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে।  বিষয়গুলো আমরা দেখছি। ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এসব ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। থানাকে এমন কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি যে, ডাকাতি মামলা নেওয়া যাবে না। শক্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেকোনো ঘটনায় মামলা নিতে হবে। এসব বিষয়ে রোববার আমাদের ক্রাইম কনফারেন্সে আলোচনা হয়েছে। আর সেখান থেকে এসব বিষয়ে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলন

মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা অভাবের ডাকাতির ঘটনা বেশি ঘটছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যখন কোনো অপরাধ ঘটে, এর আগেই অপরাধীরা নিরাপদ এলাকা বেছে নেন। বাসটি যখন ১২ ঘণ্টা ধরে ঘুরছিল এবং ডাকাতি হচ্ছিল তখন বাসটিকে নজরদারিতে আনা হয়নি। যখনই এরকম কয়েকটি ঘটনা ঘটে তখনই আমরা তৎপরতা শুরু করি। তারপর এসব ঘটনা আবার কমে যায়। এখানে আমরা কারো অবহেলার বিষয়টি বলতে চাচ্ছি না, আমরা যদি ঠিকভাবে এগুলা নজরদারিতে রাখি, তাহলে অটোমেটিক্যালি এসব ঘটনা কমে যাবে। 
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা হাইওয়ে পুলিশের সহায়তার বিষয়টি স্বীকার করে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, এমন কোন তথ্য আমাদের দেয়নি গ্রেফতাররা।

এত ডাকাত কোথা থেকে এলো জানতে চাইলে ডিবি প্রধান বলেন, আমরা ডাকাত চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করি। দেখা যায় মামলার বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে তারা আবার জামিনে বের হয়ে একই পেশায় যুক্ত হন। তাদের গ্রেফতার করতে যত সময় লাগে, এর আগেই তারা আবার জামিন নিয়ে বের হয়ে যান।

চিকিৎসক যে বাসে ডাকাতি এবং নির্যাতনের শিকার হন, সেটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাসটি ডাকাত দল একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে ভাড়া করে। তাহলে বাসের কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে জড়িত কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত বাসের কর্তৃপক্ষের কোনো জড়িত থাকার প্রমাণ আমরা পাইনি। সাধারণত দেখা যায়, ডাকাতদলের সদস্যরা বাসটিকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকা দিয়ে ভাড়া করেন। তারা তাদের সুবিধামতো জায়গায় যাওয়ার পর বাসের চালক ও হেলপারকে জিম্মি করে ফেলে। আবার অনেক সময় কম যাত্রী দেখে বাসে উঠে ডাকাতরা চালক ও হেলপারকে জিম্মি করে ফেলেন।

১২ ঘণ্টা ধরে বাসটিতে ডাকাতি চললেও কোনো পুলিশ চেকপোস্টে ধরা পড়েনি কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাতে অনেক গাড়ি এক সঙ্গে চলাফেরা করে। দেখা যায় রাস্তায় ৫০০ গাড়ি একসঙ্গে চলছে। এর মধ্যে একটিতে ডাকাতি হচ্ছে। এ কারণে নজরদারিতে পড়েনি। 

ডাকাতদলের হাতে নির্যাতনের শিকার টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শফিকুল ইসলাম ২০ জানুয়ারি ঢাকা থেকে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর থেকে ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী একটি বাসে উঠেন। ওই বাসেই যাত্রী বেশে উঠে পড়ে ডাকাত দল। পরে তাকেসহ অন্য যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করেন ডাকাতরা।

এমএসি/আরএইচ