দেশের ৬৪ জেলার সব উপজেলায় জরায়ুমুখ-স্তনক্যান্সার স্ক্রিনিং ফ্যাসিলিটি চালু হচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশে জরায়ুমুখ-স্তনক্যান্সার স্ক্রিনিং, ব্যবস্থাপনা এবং ফলোআপের জন্য কার্যকর রেফারাল পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেক্যান্সার-জনিত মাতৃ মৃত্যুহার কমানোর চেষ্টা করা হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) বাস্তবায়িতব্য প্রকল্পটির ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্পের আওতায় প্রথমে সারা দেশের ২০০টি উপজেলা থাকলেও সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের প্রত্যেক উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায় বিএসএমএমইউ।

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রথমে সাড়ে ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০১৮ সাল থেকে জুন ২০২১ সালে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘ইলেকট্রিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যা ভিত্তিক জরায়ুমুখ-স্তনক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি (ইপিসিবিসিএসপি)’ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। পরে প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৫৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা এবং মেয়াদ এক বছর বেড়ে হয় জুন ২০২২ সাল পর্যন্ত। বর্তমানে প্রকল্পটির পরিধি ও কার্যক্রম বাড়িয়ে দ্বিতীয় সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। দ্বিতীয় সংশোধনীতে ব্যয় ১৯৮ কোটি টাকা ৯৫ লাখ টাকা এবং সময় আরও দুই বছর বাড়িয়ে জুন ২০২৪ সাল পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিএসএমএমইউ জানায়, বাংলাদেশে জরায়ুমুখ-স্তনক্যান্সার স্ক্রিনিং, ব্যবস্থাপনা এবং ফলোআপের জন্য কার্যকর রেফারাল পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেক্যান্সার-জনিত মাতৃ মৃত্যুহার কমানো হবে। সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে (ইনস্টিটিউটস, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নির্বাচিত কমিউনিটি ক্লিনিক) ইলেকট্রনিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যা ভিত্তিক জরায়ুমুখ-স্তনক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচির আওতায় অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরায়ুমুখ-স্তনক্যান্সার চিকিৎসার পূর্ব সুবিধা শক্তিশালী করা হবে। পাশাপাশি জরায়ুমুখ-স্তনক্যান্সার রোগীদের উন্নত চিকিৎসা সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলজি ভবনে (ব্লক-এফ) ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের মাধ্যমে ৩৩ হাজার ৫১২ বর্গফুট জায়গায় অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে জরায়ুমুখ-স্তনক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ৯০টি শয্যা বাড়ানো ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। ৬৪টি জেলা ও ৪৯২টি উপজেলায় জরায়ুমুখ-স্তনক্যান্সার স্ক্রিনিং ফ্যাসিলিটি যুক্ত করা হয়েছে সংশোধন প্রস্তাবে। প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ইলেকট্রনিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যা ভিত্তিক জরায়ুমুখ-স্তনক্যান্সার স্ক্রিনিং সেবা প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালী করা হবে। এছাড়া ৬০০টি সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে (ইনস্টিটিউটস, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) কর্মরত ৯ হাজার ১৬৬ জন (কর্মকর্তা, চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফ ও এফডাব্লিউভি) সেবা প্রদানকারীকে ইলেকট্রনিক ডাটা ট্রাকিংসহ জনসংখ্যা ভিত্তিক জরায়ুমুখ-স্তনক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচিতে সেবা দিতে দক্ষতা বৃদ্ধি করা হবে।

তিনি বলেন, বিএসএমএমইউতে ব্রেস্ট ক্লিনিক স্থাপন ও নির্বাচিত ৬ হাজার ৫৭০টি কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত ২৬ হাজার ২৮০ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে (এইচআই/এএইচআই/এইচএ/সিএইচসিপি/এফডাব্লিউএ/এমএইচসিভি/অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী) ইলেকট্রনিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যা ভিত্তিক জরায়ুমুখ-স্তনক্যান্সার স্ক্রিনিং রেফারাল ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বাড়ানো হবে। একইসঙ্গে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জেলা হাসপাতালে আঞ্চলিক রেফারাল কেন্দ্র শক্তিশালী করার লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণে সহযোগিতা করার পাশাপাশি স্ক্রিনিং, কল্লোস্কোপি, চিকিৎসা ও ইলেকট্রনিক ডাটা ট্র্যাকিং ব্যবস্থাপনা চালু করা হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের সিনিয়র সহকারী প্রধান সাইনী আজিজ প্রকল্পের বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্টিয়ারিং কমিটির মিটিং অনুযায়ী প্রকল্পটির কার্যপরিধি বাড়ানো হয়েছে। প্রথমে প্রকল্পের মাধ্যমে ২০০টি উপজেলায় কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন দেশের সব উপজেলায় প্রকল্পের কাজ করা হবে। সেজন্য প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটির ওপর আগামী ২৭ জানুয়ারি পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি নেওয়াই হয়েছে ব্রেস্টক্যান্সার ও জরায়ুমুখক্যান্সারের স্ক্রিনিংয়ের জন্য। কাজেই নারীদের জন্য প্রকল্পটি সহায়ক হবে। তাছাড়া প্রকল্পের কাজ কিন্তু খারাপ হয়নি। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ ৫৫ বা ৫৬ শতাংশ হয়েছে। সুতরাং প্রকল্পটির বাস্তবায়ন যথাসময়ে শেষ হলে সুফল পাবে জনগণ।’

জাতীয়ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউটেরক্যান্সার এপিডেমিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ক্যান্সারের এ কর্মসূচিতে গত ১৫ বছরে মাত্র ১০ শতাংশ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।ক্যান্সারের একটা স্ক্রিনিং নিয়ে যে তাত্ত্বিক দিক আছে, এ বিষয়টা বিএসএমএমইউয়ের কর্মসূচিতে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ পুরো প্রোগ্রামটা চলছে একটা ফ্যাসিলিটি বেইজড। হাসপাতালে ভায়া সেন্টারের মাধ্যমে। ভায়া সেন্টারে মানুষজন আসবে এবং টেস্ট করিয়ে চলে যাবে। কিন্তু মানুষকে যে বুঝিয়ে নিয়ে আসতে হবে সে বিষয়ে, সেটা কিন্তু হচ্ছে না। এজন্য গত ১৫ বছরে সরকার ১০ শতাংশ কাভারেজের কথা বললেও আসলে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বাস্তবে এ কর্মসূচির মাধ্যমে কাভারেজ হয়েছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ।’

তিনি বলেন, ‘এখন এ কাভারেজ বাড়াতে হলে আমাদের কী করতে হবে? প্রথমেই আমাদের হাসপাতাল ভিত্তিক পদ্ধতি থেকে বের হয়ে কমিউনিটি ভিত্তিক প্রোগ্রামে যেতে হবে। এবার ইউনিয়ন পর্যায় থেকে কোভিডের ভ্যাকসিন দিতে যেভাবে কাজ করা হয়েছে, সেভাবে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে এ প্রোগ্রাম শুরু করতে হবে। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কি পরিমাণ এক্যান্সার রোগী আছে, সেটা এ কর্মসূচির পিডি বা ঢাকা থেকে বসে নির্ণয় করা সম্ভব না। এ কর্মসূচির মাধ্যমে বাইপাস করার জন্য ট্র্যাকিং সিস্টেম করা হয়েছে। এ সিস্টেমে শুধু ধারণা পাওয়া সম্ভব। কিন্তু নির্ণয় করা সম্ভব না। সত্যিকার অর্থেক্যান্সারের ইনসিডেন্ট বের করতে গেলে তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। কিন্তু এগুলো এ কর্মসূচিতে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না।’

ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন আরও বলেন, ‘এক্যান্সারের সাপোর্ট দিতে গিয়ে আমরা ওরালক্যান্সারের নাম ভুলে গেছি। ব্রেস্টক্যান্সার নিয়েও কোনো আলাপ নেই। এ সিস্টেমে একটা পরিবর্তন থাকতে হবে। এ প্রকল্পে আমরা যারাক্যান্সারের বিষয়ে জানি তাদের সম্পর্কিত করা হয়নি। এ কর্মসূচিটা আমরা ক্লিনিক্যাল বেইজড করে ফেলছি। বাংলাদেশে যেভাবে এ কর্মসূচিটা চলছে, পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে চলছে না। যেই জিনিসটা কমিউনিটি লেভেল থেকে হবে, আমরা সেটা ঢাকা থেকে বসে করার চেষ্টা করছি। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে সংশ্লিষ্ট ইউনিটকে শক্তিশালী করতে হবে।’

পিইসি সভায় যেসব বিষয়ে আলোচনা করা হবে—

১. ডিসেম্বর ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিভূত অগ্রগতির বিষয়ে পিইসি সভায় জানাতে হবে।

২. প্রকল্পের আওতায় আউটসোর্সিং খাতে নতুন করে ৪৫ জনের প্রস্তাব করা হলেও ৩৭ জনের জন্য অর্থ বিভাগের কোনো সুপারিশ নেই। প্রস্তাবিত ৩৭ জনের পরিবর্তে আট জনের সংস্থান রাখা যেতে পারে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় তিনটি গাড়ির প্রস্তাব করা হলেও আউটসোর্সিং খাতে চার জন ড্রাইভারের সংস্থান রাখা হয়েছে, যার যৌক্তিকতা জানা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত আরডিপিপিতে তিনটি যানবাহনের সংস্থান থাকলেও ‘মেরামত ও সংরক্ষণ’ এর আওতায় চারটি যানবাহন মেরামতের ব্যয় প্রাক্কলন দেখানো হয়েছে।

৩. প্রকল্পের অর্থায়নের নিশ্চয়তা সংক্রান্ত সচিবের প্রত্যয়নপত্র ও এমটিবিএফ সংক্রান্ত তথ্য আরডিপিপিতে সংযুক্ত করা হয়নি।

৪. প্রকল্পের আওতায় যেসব ‘যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি’ ‘বই ও সাময়িকী’ এবং ‘ইন্টারনেট/ফ্যাক্স/টেলেক্স’ ক্রয়ের ক্ষেত্রে অদ্যাবধি চুক্তি সম্পাদিত হয়নি, সেসব ক্ষেত্রে ক্রয় পদ্ধতি হিসেবে আরএফকিউএম ও ডিপিএমের পরিবর্তে ওটিএমের সংস্থান রাখা প্রয়োজন। অনুরূপভাবে, সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে ‘কনসালটেন্সি’ ব্যতীত সব ক্ষেত্রে ক্রয় পদ্ধতি হিসেবে যেকোনো একটি পদ্ধতির এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ওটিএমের সংস্থান রাখা প্রয়োজন। ক্রয় পরিকল্পনায় অন্যান্য ব্যয় নামক খাতের ক্ষেত্রে ক্রয় পদ্ধতি হিসেবে ডিপিএম/অন্যান্য উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টির স্পষ্ট করা প্রয়োজন। এছাড়া অন্যান্য ব্যয় বলতে কোন খাতকে বুঝানো হয়েছে সেটি সভাকে জানাতে হবে। ক্রয় অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ সরকারি ক্রয় বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী সঠিকভাবে উল্লেখ করতে হবে।

৫. প্রকল্পের আওতায় ‘ইলেক্ট্রোসার্জিক্যাল ইকুইপমেন্ট উইথ হারমোনিক স্কালপেল সেট (২০ লাখ টাকা), অটোক্লেভ (৪০ লাখ টাকা), ম্যামোগ্রাফি মেশিন অ্যান্ড একসেসরিজ এবং সিআর মেশিন’ (২ কোটি ২০ লাখ টাকা), আলট্রাসাউন্ড মেশিন ও অন্যান্য একসেসরিজ (১ কোটি ৮০ লাখ টাকা) সহ বেশকিছু নতুন যন্ত্রপাতির প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া কতিপয় যন্ত্রপাতির ইউনিটপ্রতি মূল্য অনুমোদিত আরডিপিপি অপেক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিষয়গুলোর যৌক্তিকতা জানা প্রয়োজন।

৬. আসবাবপত্রের আওতায় বেশকিছু নতুন যন্ত্রপাতির প্রস্তাব করা হয়েছে, যার প্রয়োজনীয়তা জানা যেতে পারে। এছাড়া নতুন প্রস্তাবিত আসবাবপত্রের মধ্যে হাসপাতাল বেড-এর সংস্থান রাখা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পসহ সেক্টর কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন হাসপাতালে বেড সরবরাহ করা হয় বিধায় এ প্রকল্প থেকে হাসপাতালে বেড-এর সংস্থান বাদ দিতে হবে।

৭. প্রস্তাবিত সব আসবাবপত্র ‘চেয়ার-ক্লাস রুম’ ও ‘চেয়ার-অফিস’ এ রূপে উল্লেখের পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী উল্লেখ করা প্রয়োজন। এছাড়া অনুমোদিত আরডিপিপিতে সংস্থান করা আসবাবপত্রের প্রত্যেকটির পরিমাণ বৃদ্ধির সুস্পষ্ট যৌক্তিকতা জানাতে হবে।

এসআর/এসএসএইচ