বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের আইনের আওতায় আনার দাবি
দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস, নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও দুর্নীর অভিযোগ ওঠায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ।
রোববার (২৩ জানুয়ারি) একাদশ জাতীয় সংসদের ষোড়শ অধিবেশনে 'প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ নামে খসড়া আইনটি উত্থাপনের বিরোধিতা করে তিনি এ দাবি জানান।
বিজ্ঞাপন
এর আগে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল হক আইনটি সংসদে উত্থাপনের জন্য স্পিকার ড. শিরীন শারমিনের অনুমতি চান।
এ সময় বিলটি তোলার আপত্তি করেন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ। তিনি বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের (বর্তমান নির্বাচন কমিশন) মেয়াদ শেষ হবে। তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার এবং দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সেগুলোর ব্যাপারে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা খুবই জরুরি।
আগের সার্চ কমিটির ‘বৈধতা’ দেওয়ার জন্য আইনটি আনা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। তবে বিলটি কণ্ঠভোটে তা নাকচ হয়। এর আগে বিএনপির সংসদ সদস্যের বক্তব্যের জবাব দেন আইনমন্ত্রী।
আগের সার্চ কমিটির ‘বৈধতা’ দেওয়ার বিষয়ে আইনমন্ত্রী সংসদে বলেন, দুবার যে সার্চ কমিটি করা হয়েছিল, তা ঐক্যমতের ভিত্তিতে। সেটাকে আইনসিদ্ধ করা হচ্ছে।
বিলটি সংসদে ওঠানোর বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, যে বিলটি আইনমন্ত্রী এনেছেন, তাতে জনগণের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক দলগুলোর এবং সুশীল সমাজের যে প্রত্যাশা, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য একটি আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে আসছিলাম। আজকে আইনমন্ত্রী যে বিলটি উত্থাপন করেছেন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, ‘যাহা লাউ তাহা-ই কদু’।
তিনি বলেন, অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে বলতে চাই, সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে বিগত যে দুটি নির্বাচন কমিশন, রকিব ও হুদা কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে এত প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৬ সালে বলেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না। ১৯৯৫-৯৬ সালে দীর্ঘ ১৭২ দিন হরতালের মধ্যদিয়ে আজকের প্রধানমন্ত্রী সেই সময় দাবি করেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া কোনো নির্বাচনে যাবেন না।
হারুনুর রশিদ বলেন, আজকে যে আইনটি তোলা হয়েছে তাতে ধরে নিতে পারি ইতোপূর্বে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুটি কমিশনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য আনা হয়েছে। এখানে নতুনত্ব কিছু নেই। ইতোপূর্বে যে কমিশন গঠিত হয়েছে তার অনুরূপ বিল এখানে তোলা হয়েছে।
সার্চ কমিটির সদস্যদের তথ্য তুলে ধরে বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, এই আইনটি প্রশ্নবিদ্ধ। এই আইন দিয়ে বর্তমান সংকটের নিরসন হবে না। সংকট থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না। আমি দাবি করব- আইনটি প্রত্যাহার করুন। আইনমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছিলেন এরকম একটি আইন প্রণয়নের জন্য রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এই কথা বলার পর তিনি কী করে এই আইনটি আনেন।
হারুনুর রশিদের বক্তব্যের জবাবে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে, ওনাদের ইতিহাস বলতে হয়। নিজেরা নিজেরা নির্বাচনে জয়লাভের জন্য যতরকম কারসাজি-বিচারপতি আজিজ সাহেবকে দিয়ে কমিশন গঠন, এক কোটি ৩০ লাখ ভুয়া ভোটার তৈরি, একজন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার জন্য বিচারকদের বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করেছিলেন। এটা ওনারা কার সঙ্গে আলোচনা করে করেছিলেন? ওনারা এখানে বসে নিজেরা নিজেরা করে ফেলেছিলেন। ওনারা কারো সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন মনে করেননি। কারচুপি করে ক্ষমতায় আসার জন্য ওনারা নিরবচ্ছিন্ন ইলেকশন করতে চেয়েছিলেন। মানে কারচুপি করে ক্ষমতায় আসার জন্য।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির ভোটের তফসিল প্রসঙ্গ টেনে আইনমন্ত্রী বলেন, ওনারা ২২ জানুয়ারি নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন করতে হবে। আমরা সেই আইন করেছি। ওনারা বুঝে বলুক না বুঝে বলুক, বলছেন এটা সার্চ কমিটির আইন। ওনারা বলছেন আইনটা আমরা ঠিক করিনি। ওনাদের সঙ্গে আলোচনা করিনি।
আইনটি সংসদে তোলার কারণ ব্যাখ্যা করে মন্ত্রী বলেন, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এনজিও আমার কাছে একটি ড্রাফট দিয়েছিল। যখন আমি বলেছিলাম, এই সংসদে পাস করে, কোভিড সিচুয়েশেনের জন্য, এই সংসদে পাস করা করা সম্ভব হবে না, অন্য কিছু না, কোভিড সিচুয়েশনের জন্য। প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালেই বলেছিলেন এই আইন করা প্রয়োজন। ওনারা বলেছিলেন অর্ডিন্যান্স করে আইন করে দিতে হবে। আমি বলেছিলাম এই আইন সংসদে না এনে করা ঠিক হবে না। সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংসদে তার পরে করা উচিত।
আইনমন্ত্রী সার্চ কমিটি গঠনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের উদ্যোগের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, তখন একটা কনসেনশাস হয়েছিল। তখন গেজেট হলো। নির্বাচন কমিশন গঠন হলো। পরেরবার আবার একইভাবে হলো। এটা আইন ছিল না কিন্তু এটা ছিল ফোর্স অব ল’। কারণ এটি রাষ্ট্রপ্রধান করেছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ে বড় কেউ না। তখন বিএনপির আপত্তি ছিল না।
খসড়া আইন থেকে সার্চ কমিটির বিধান তুলে ধরে আনিসুল হক বলেন, উইদাউট প্রেজুডিস বলছি, যদি কোনো নির্বাচন কমিশনার কোনো অন্যায় করে থাকে, তাহলে কী তাকে এই আইনের নয় দফায় তাকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে? মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে দুবার সার্চ কমিটি করেছেন, সেটাও আইনসিদ্ধ ছিল। সেটাও আইনের আওতায় আনা হলো। এটা কনসেনশাসের ভিত্তিতে করা হয়েছিল। ওনাদের কথা হচ্ছে, যা করেন করেন, তাল গাছ আমার। তাল গাছ ওনাদের না। তাল গাছ জনগণের। ওনারা না বুঝে বলছেন। আইনটা যখন করে ফেললাম পালের হাওয়া চলে গেছে। সেজন্য এখন কী বলবেন। এইটা নাই, ওইটা আছে। ওইটা নাই, এসব নাচগান শুরু করে দিয়েছেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, ওনারা চান ওনাদের পকেটে যে নাম সেই নাম দিয়ে ইসি গঠন হবে। সেটা হবে না। এটা বাংলাদেশ। জনগণ ঠিক করবে। কোনো দল অগ্রাধিকার পাবে না।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় বিরোধী দলের আসন থেকে হারুন কথা বলা শুরু করলে আনিসুল হক বলেন, ওনারা (বিএনপি) না শুনলে শিখবেন কীভাবে। বুঝবেন তো না, শিখবেন কী?
সার্চ কমিটির গঠন খসড়া আইন থেকে তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, চারজন সাংবিধানিক পদের অধিকারী। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলেও, চাকরিচ্যুত করতে পারবেন না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি পছন্দ না করলেও দশজনের ভেতর তাকে থাকতে হবে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অনিয়মের বিচারের জন্য হারুনের দাবি প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, আগে আজিজ কমিশনের বিচার করতে হবে। এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটারের বিচার করতে হবে। এত তাড়াতাড়ি তিনতলায় ওঠা যাবে না।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে আইনমন্ত্রী বলেন, কোথাও এরকম স্বচ্ছ ইসি গঠনের নিয়ম নেই।
এই আইনের মধ্যে ইসি গঠন হলে বিএনপি ‘ভোট চুরি’ করতে পারবে না মন্তব্য করে আইনমন্ত্রী আরও বলেন, এরজন্য তাদের ‘গাত্রদাহ’ শুরু হয়েছে।
এইউএ/জেডএস