ধর্ষণ থামবে কবে, কীসে?
দেশে কোনোভাবেই থামছে না ধর্ষণের ঘটনা। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় সবাই উদ্বিগ্ন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৩২১টি, ধর্ষণ শেষে খুন হওয়ার ঘটনা ৪৭টি। তার আগে ২০২০ ও ২০১৯ সালে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন যথাক্রমে ১৬২৭ ও ১৪১৩ জন। ধর্ষণ শেষে খুন হয়েছেন ৫৩ ও ৭৬ জন।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ২০২০ সালে আইন পাস হয়েছে জাতীয় সংসদে। তবু ‘ধর্ষণ-উৎসবে’র লাগাম টানা যাচ্ছে না। কিন্তু কেন?
বিজ্ঞাপন
শুধু আলাদাভাবে ধর্ষণের শাস্তি দিয়ে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক মনে করেন, শুধু শাস্তি নিশ্চিত করলেই ধর্ষণের মতো অপরাধ দমন হবে না। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘সমাজের স্তরে স্তরে সীমাহীন দুর্নীতি। সবক্ষেত্রে অনাচার, মানুষে মানুষে বৈষম্য, অবিচার, দুর্নীতি বাড়ছে। এর সঙ্গে ধর্ষণের সম্পর্ক আছে। সবগুলো বিষয় ধরে ধরে সমাধান করতে হবে। তা না হলে শুধু মৃত্যুদণ্ড বা শাস্তি দিয়ে ধর্ষণের হয়তো সাময়িক সমাধান হবে; স্থায়ী সমাধান হবে না।’
গত বছর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৩২১টি, ধর্ষণ শেষে খুন হওয়ার ঘটনা ৪৭টি। তার আগে ২০২০ ও ২০১৯ সালে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন যথাক্রমে ১৬২৭ ও ১৪১৩ জন। ধর্ষণ শেষে খুন হয়েছেন ৫৩ ও ৭৬ জন
‘রাজনীতি সবচাইতে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত’— উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সামাজিক অন্যায়, অবিচার, আইন-কানুন, রীতিনীতি যদি খারাপ থাকে; যদি বৈষম্য বাড়তেই থাকে, দুর্নীতির দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে ধর্ষণের প্রতিকার হবে না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র ও জনগণ সীমাহীন দুর্নীতি, বৈষম্য, অবিচার ও অন্যায় সহ্য করে নিচ্ছে। ধর্ষণটাও সমাজ সহ্য করে নেবে।’
‘ধর্ষণ নারীর ওপর কর্তৃত্বের হাতিয়ার’— উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের সমাজে বরাবরই নারীরা নিগৃহীত। তাদের দুর্বল ও অসম্পূর্ণ মানুষ মনে করা হয়। এমনকি কোনো কোনো শ্রেণি-গোষ্ঠী নারীকে অচ্ছুৎও মনে করে। ফলে নারীর ওপর আধিপত্য বিস্তার এবং তার ওপর কর্তৃত্ব করতে চাওয়া হয়। ধর্ষণ সেই ইচ্ছা পূরণে একটি হাতিয়ার বিশেষ।’
‘যৌন চাহিদা পূরণ করা অধিকাংশ ধর্ষণের মূল উদ্দেশ্য নয়’— এমনটি মনে করেন খ্যাতনামা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। তিনি বলেন, ‘একজন বা একদল পুরুষ যখন ধর্ষণ করে তখন ওই নারীর ওপর তারা জয়লাভ করতে চায়। তাকে দলিত ও নিপীড়িত করে শ্লাঘা অনুভব করে। ধর্ষণের পর প্রমাণ মুছে ফেলার পাশাপাশি বিকৃত আনন্দ লাভের জন্য খুনও করা হয়।’
আসক বলছে, ২০২১ ও ২০২০ সালে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন যথাক্রমে ২৫২ ও ৩১৭ জন। তাদের মধ্যে ৩২ জনেরই বয়স ১৩ বছরের কম। ভয়াবহ এই চিত্রই বলে দেয় দেশে ‘ধর্ষণের উৎসব’ চলছে— এমনটা মনে করছেন সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দেশ ক্রমাগত মধ্যযুগীয় অন্ধকারের দিকে হাঁটছে।
জাতিকে সুশিক্ষা দান এই অবস্থা থেকে স্থায়ী মুক্তির অন্যতম প্রধান উপায় বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে লিঙ্গ বৈষম্য নিশ্চিহ্ন করতে হবে। শিশুকালেই নারী-পুরুষের ভেদাভেদ দূর করে সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দিতে হবে।
ধর্ষণমুক্ত সমাজ গঠনে শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রফেসর আনিসুজ্জামান বলেন, ‘দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যৌন শিক্ষার বালাই নেই। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েও অনেকে শরীরবৃত্তীয় বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যান। অথচ কৈশোরেই যৌন শিক্ষা দিলে প্রচলিত অনেক ‘ট্যাবু’ ভেঙে দেওয়া যায়। এতে লিঙ্গবাদ দূর হবে। আধিপত্যকামী মানসিকতা দূর হবে। ফলশ্রুতিতে কমবে ধর্ষণ প্রবণতা।’
দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে পর্নোগ্রাফিও একটা বড় কারণ বলে মনে করেন অনেকে।
এ প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আনোয়ারা সৈয়দ হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি শারীরিক-মানসিক নানা ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে এটি ধর্ষণে উৎসাহিত করে বলে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। আমি মনে করি, মানুষের স্বাভাবিক যৌন চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দেওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ দেশে তরুণ-তরুণীর প্রেমের সম্পর্কও দেখা হয় অস্বাভাবিক চোখে। এখানে প্রকাশ্যে ঘুষ খেলে কেউ তাকিয়ে দেখে না। কিন্তু প্রেমিকযুগল রিকশায় হাত ধরে বসলেই বাঁকা চোখে দেখা হয়।’
তবে মাদকের অবাধ ব্যবহার ও সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা গেলে ধর্ষণের সংখ্যা কিছু কমবে বলে মনে করেন তিনি।
ধর্ষণের কারণ হিসেবে অনেকে নারীর পোশাককেও দায়ী করে থাকেন। এর বিরোধিতা করে নাট্যনির্মাতা ও লেখক মোস্তফা মনন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ধর্ষণের সঙ্গে পোশাকের কোনো সম্পর্ক নেই। পোশাকের কারণে ধর্ষণ হলে শিশু ধর্ষণের কারণ কী? পৃথিবীতে এমন অনেক উপজাতি রয়েছে যেখানে মেয়েরা স্বল্পবসনা। কিন্তু সেখানে পুরুষদের মধ্যে ধর্ষণ-প্রবণতা নেই।’
ধর্ষণ ও প্রতারণা
ইদানীং দেখা গেছে কিছু নারী সম্পর্কের অবনতি হলে প্রেমিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তুলছেন। যদিও তিনি হয়তো স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। আবার অনেকে বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে ধর্ষণের অভিযোগও করছেন। বিষয়টা কীভাবে দেখছেন— জানতে চাইলে তরুণ কবি ও প্রকাশক অচিন্ত্য চয়ন পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘উভয়ের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্কের পর প্রতিশ্রুতি ভাঙলে সেটা প্রতারণা হতে পারে, ধর্ষণ কেন হবে? এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত।’
এ বিষয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী রওশন আলী বলেন, ‘পারস্পরিক সম্মতিতে প্রেমিক-প্রেমিকার শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে ধর্ষণ— বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা ও আলাদা শাস্তির বিধান থাকা দরকার।’
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধারা ৯ (১) এর ব্যাখ্যায় ধর্ষণ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ছাড়া ১৬ বছরের বেশি বয়সের নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।’ অর্থাৎ, ১৬ বছরের কম বয়সী মেয়ে হলে তার সম্মতি থাকলেও তা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে। কারণ, বয়স কম হওয়ার কারণে তার স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই।
নারী আপস করতে বাধ্য হয় অথবা পালিয়ে বেড়ায়
লজ্জা ও ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী নারী ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করেন না। প্রকাশিত অনেক ঘটনা আবার ধামাচাপা দেওয়া হয় ভয়-ভীতি ও অর্থের বিনিময়ে। আসকের তথ্য বলছে, এসবের পরেও গত দুই বছর দেশে ধর্ষণ মামলা হয়েছে দুই হাজার ৫৬টি।
তবে পুরোনো সাক্ষ্য আইনে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীর বিচার পাওয়ার সুযোগ কম বলে মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একটা মেয়ে ভিকটিম হওয়ার পর যদি মামলা করতে চায়, তখন সে বারবার ধর্ষণের শিকার হয়। সে থানায় যখন যায় তখন শিকার হয়, পত্রিকার লোকেরা যখন কথা বলে তখনও ধর্ষণের শিকার হয়।’
ভুক্তভোগী সুরক্ষা আইন নেই— জানিয়ে সালমা আলী বলেন, ‘একজন নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর শারীরিক-মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন তাকে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে রাখা দরকার। অনেক পুরোনো এই সাক্ষ্য আইনে সেটা নেই। ভুক্তভোগীর জন্য নেই কোনো কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা। বরং ধর্ষণের সময় এমন এমন বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় যা ভিকটিমের জন্য একধরনের পীড়ন। এসব নানা কারণে অনেকে মামলা চালাতে চান না।’
অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘এখনও কিন্তু পাবলিক প্রসিকিউটর ও জজ সাহেবরা নারীবান্ধব নন। যদিও হাইকোর্টের ভালো ভালো কয়েকটা জাজমেন্ট আছে।’
তিনি বলেন, ‘আসামিপক্ষ সব সময় বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত করার চেষ্টা করে। তারা তাতে সফলও হয়। কারণ, এখানে করাপশনের (দুর্নীতি) সুযোগ আছে, পলিটিক্যাল বায়াসনেস (রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা) আছে। ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা রেপিস্টরা এসবের সুযোগ নেয়। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী কিন্তু একপর্যায়ে আপস করতে বাধ্য হয় অথবা পালিয়ে বেড়ায়।’
দ্রুত বিচারের জন্য কোর্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সাক্ষ্য আইনের পরিবর্তন দরকার। ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষা আইনের যে খসড়া আছে সেটিও দ্রুত (পাস) হওয়া দরকার। এছাড়া পাবলিক প্রসিকিউটর ও জাজদের ধর্ষণ মামলার বিচার সংক্রান্ত বিশেষ ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। তবে সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারের সদিচ্ছা ও জবাবদিহিতা।’
আইনে আছে ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে ধর্ষণের দ্রুত বিচারের তেমন কোনো নজির এখনও স্থাপিত হয়নি দেশে। মামলা শেষ হতে কখনও কখনও ১০ থেকে ২০ বছর লেগে যাচ্ছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও সঠিক বিচারের অভাবও ধর্ষণের ঘটনা না কমার জন্য দায়ী বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
এইচকে/জেএস/এমএআর