এমভি অভিযান-১০ : নাগরিক তদন্ত কমিটির ২৫ সুপারিশ
এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শুধু মালিক, মাস্টার ও ড্রাইভারকে শাস্তি না দিয়ে এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনাসহ ২৫ দফা সুপারিশ জানিয়েছে নাগরিক তদন্ত কমিটি।
তারা দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণের আইন প্রণয়ন, টাকার পরিমাণ নির্ধারণ এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী (নৌযান মালিক/মাস্টার/ড্রাইভার/সরকারি কর্মকর্তা) ব্যক্তিদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করারও সুপারিশ করেন।
বিজ্ঞাপন
শনিবার (২২ জানুয়ারি) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব সুপারিশ ও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রধান সমন্বয়ক আশীষ কুমার দে।
তদন্ত কমিটির অন্যান্য সুপারিশগুলো হচ্ছে— প্রত্যেক যাত্রীবাহী নৌযানে আনসার/সিকিউরিটি থাকা বাধ্যতামূলক করা; যাত্রীবাহী লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষ, প্রবেশপথ, মাস্টারব্রিজসহ স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা; যেকোনো নৌযানের নকশায় অগ্নি-নিরাপত্তার বিষয়টি যুক্ত, সে অনুযায়ী নকশা অনুমোদন এবং যথাযথভাবে নকশা অনুসরণ করে নৌযান নির্মাণ করা; নতুন নৌযানে অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিক আছে কিনা, তা নিশ্চিত হতে ফায়ার সার্ভিস বিভাগের ছাড়পত্র গ্রহণ এবং ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক প্রতি তিন মাস পরপর তা পরীক্ষা করা।
সুপারিশে আরও রয়েছে, চলমান নৌযানগুলো বিশেষ করে লঞ্চ ও অন্যান্য যাত্রীবাহী নৌযানের অগ্নি-প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কিনা, তা আগামী ছয় মাসের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পরীক্ষা করা; লঞ্চের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার না করা; ইঞ্জিন কক্ষের পাশ থেকে খাবারের হোটেল সরিয়ে নেওয়া এবং ইঞ্জিন কক্ষ ও ক্যান্টিনের আশেপাশে জ্বালানি তেলসহ কোনো দাহ্য পদার্থ রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা; নৌযানের ইঞ্জিন কক্ষে আগুন লাগলে তা দ্রুত নেভানোর জন্য স্থায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড সরবরাহ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা।
নৌযানের কর্মীদের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র পরিচালনার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক ও বছরে অন্তত এক বার মহড়ার ব্যবস্থা করা; প্রত্যেক নাবিকের ইউনিফর্ম পরিধান বাধ্যতামূলক করা; আইএসও ৫৮(ক) ধারা মোতাবেক যাত্রীবাহী নৌযানের বিমা অথবা নৌ দুর্ঘটনা ট্রাস্ট ফান্ড বাধ্যতামূলক করা; যেকোনো নৌ-দুর্ঘটনা সুষ্ঠু তদন্তের জন্য অভিজ্ঞ নৌ-স্থপতি, নৌ-প্রকৌশলী, পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ, মাষ্টার মেরিনার, নৌ পরিবহনবিষয়ক গবেষক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জ্যেষ্ঠ গণমাধ্যমকর্মী এবং নৌ মন্ত্রণালয়, নৌ অধিদফতর, নৌযান মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের একজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে জাতীয় তদন্ত কমিটি গঠন।
প্রত্যেক দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট এবং নারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা নৌ মন্ত্রণালয় ও নৌ অধিদফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা; আধুনিক ও ত্রুটিমুক্ত নৌযান নির্মাণের স্বার্থে নকসা অনুমোদনের দায়িত্ব নৌ অধিদফতর থেকে প্রত্যাহার করে একাধিক সংস্থার বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র নকশা অনুমোদন কমিটি গঠন করা; ত্রুটিপূর্ণ নৌযান চলাচল বন্ধে যথাযথভাবে ফিটনেস পরীক্ষার জন্য শূন্যপদগুলোতে অবিলম্বে নিয়োগ দিয়ে নৌ অধিদফতরের ‘শিপ সার্ভেয়ার’ সংকট নিরসন ও বার্ষিক সার্ভে প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; কোন শিপ সার্ভেয়ার কোন মাসে কতোগুলো নৌযান নিবন্ধন ও সার্ভে করছেন নামসহ সেই তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা; দক্ষ নৌযান চালক তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিসহ এ ধরনের কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন অভ্যন্তরীণ মাস্টারশিপ-ড্রাইভারশিপ পরীক্ষা বোর্ড গঠন, পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার ও পরীক্ষার্থীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি বা সমমানের নির্ধারণ করা।
এছাড়াও নৌ অধিদফতর থেকে সমুদ্রগামী নাবিকদের সার্টিফিকেট অব প্রফিশিয়েন্সি (সিওপি), অভ্যন্তরীণ নৌযান চালকদের সনদ নবায়নসহ অন্যান্য সেবা ও নৌযান মালিকদের নিবন্ধন-বার্ষিক ফিটনেস সনদ পেতে অহেতুক কালক্ষেপণ, অর্থব্যয় ও হয়রানি বন্ধ করা; নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌ অধিদফতরকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পূর্ণাঙ্গ জনবল নিয়োগ, দ্রুতগতির টহলবোটসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক জলযান ও কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি বরাদ্দ করা; রাজস্ব আদায় ও নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সারা দেশে বৈধ-অবৈধ সব ধরনের নৌযানের সংখ্যা নির্ধারণে অবিলম্বে জাতীয় নৌ-শুমারির ব্যবস্থা গ্রহণ করা; নিবন্ধন ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ অধিদফতরকে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশনা প্রদান ও এ কাজে সহায়তার জন্য নৌ-পুলিশ ও কোস্টগার্ডের পাশাপাশি জেলা-উপজেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশকে সম্পৃক্ত করা; নদী খনন ও নৌপথের পলি অপসারণ কাজের গতি বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চলমান প্রকল্পগুলোর তথ্য সবিস্তারে বিআইডব্লিউটিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা এবং বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএসহ সকল সরকারি দফতরের নৌযানসমূহকে হালনাগাদ সার্ভের আওতায় আনা ও নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থাগুলো থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন নাগরিক তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক আবু নাসের খান, সদস্য সচিব আমিনুর রসুল বাবুল প্রমুখ।
এমএইচএন/এমএইচএস