যানজটে স্কুলে যেতে অনীহা শিশুদের!
অষ্টম শ্রেণির ছাত্র জারিফ আবদুল্লাহর বাসা পুরান ঢাকার সূত্রাপুর বাজার এলাকায়। বর্তমানে সে মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়াশোনা করছে। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রায় এক বছর নয় মাস স্কুল বন্ধ থাকার পর সশরীরে ক্লাস করতে হচ্ছে তাকে। জানুয়ারির ২ তারিখ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন স্কুলে গেছে সে। তবে দীর্ঘদিন বিরতির পর এবারই প্রথম স্কুল যাওয়া নিয়ে বিরক্তিভাব লক্ষ্য করা যায় তার মধ্যে। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে স্কুলে যেতে অনীহা জারিফের। সন্তানের এমন আচরণে উদ্বিগ্ন বাবা-মা।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় জারিফের। কেন স্কুল যেতে চাও না— জানতে চাইলে বলে, সকাল ৭টায় স্কুলের জন্য তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে গাড়িতে বের হই। কিন্তু জ্যাম। যেতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগে। আড়াই ঘণ্টার ক্লাস শেষে দুপুরে বাসায় ফিরতে লাগে দুই ঘণ্টা ২০ মিনিট। প্রতিদিনই এমন হচ্ছে। গাড়িতে বসে বসে বেশ কয়েকবার ঘুমাতে হয়, বাসায় ফিরেও ঘুমাই। প্রচুর ক্লান্তি আসে। পড়াশোনা করতে মন চায় না।
বিজ্ঞাপন
জারিফের মা ফারজানা আক্তার অনন্যা বলেন, করোনার কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম স্কুল খোলে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর যানজটের কারণে স্কুলে যেতে অনীহা প্রকাশ করে ছেলে। এখনও একই অবস্থা। ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে ঘুমায়। বাসায় ফিরেও ঘুমায়। রাত ৭টা-৮টার দিকে ওঠে। কিন্তু রাতে আর ঘুম হয় না। সময়মতো পড়তে পারে না, খাওয়া-দাওয়াও অনিয়মিত। যানজটের কারণে স্কুলে না গিয়ে বাসায় প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে চাইছে। ছেলের এমন অনীহা কীভাবে দূর করব, তাকে কি ডাক্তার দেখাব— বুঝতে পারছি না!
জারিফের মায়ের মতো ঢাকা শহরের অনেক মা এখন সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। স্কুলে যাওয়া-আসার সময় তীব্র যানজটের মুখে পড়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে তাদের সন্তানরা।
মহাখালীর বাসিন্দা রিকি সালমিনা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার সন্তান ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। স্কুল উত্তরায়। বছরের শুরুতে বই নিতে স্কুলে গিয়েছিল। মাত্র তিন দিন ক্লাস করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাসায় ফিরে বলত, বমি বমি লাগছে। কিছু খেতে পারত না। কয়েকবার বমিও করেছে। পরে তাকে মেডিসিনের ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার বলেন, তার কোনো সমস্যা নাই, দীর্ঘক্ষণ যানজটে বসে থাকার কারণে এ অবস্থা।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে দেশে সীমিত পরিসরে স্কুল খুলেছে। একই সময়ে পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ওয়াসার পাইপ বসানোর কাজ চলছে। চলছে মেট্রোরেলসহ নানা উন্নয়নকাজ। এসব কাজে রাস্তা কাটা ও যানচলাচল সীমিত থাকায় অধিকাংশ সড়ক প্রায় বন্ধ। এ কারণে বেড়েছে যানজট। এছাড়া সপ্তাহিক কর্মদিবসগুলোতে নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় ইভেন্ট থাকায় যানজটের মাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠছে। অফিসগামীদের ভোগান্তি এ সময় চোখে পড়লেও অদৃশ্য রয়ে যাচ্ছে শিশুদের ভোগান্তি।
যানজট থেকে অনীহা, প্রভাব পড়ছে শিশুদের পড়াশোনায়
শিশুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের কোনো কিছুর ওপর একবার বিরক্তিভাব আসলে সেটা দীর্ঘদিন থেকে যায়। একপর্যায়ে বিষয়টির ওপর তার চরম অনীহা তৈরি হয়। একইভাবে শিক্ষার্থীরা যানজটের কারণে স্কুল যেতে বিরক্ত হচ্ছে। এর দীর্ঘমেয়াদি ফল হিসেবে একপর্যায়ে এটা তাদের পড়াশোনায় প্রভাব ফেলে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক শারাবান তাহুরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, যানজটের কারণে শিশুদের দিনের শুরুটা হয় টেনশন বা স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে। তারা ভাবে, যানজটের কারণে স্কুলে যেতে দেরি হলে শাস্তি পেতে হবে। হয়তো স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এমন স্ট্রেস শিশুদের মনোজগতে প্রভাব ফেলে। মনোজগতে ভীতির সৃষ্টি করে। এ ভীতির কারণে স্কুলের প্রতি তাদের আকর্ষণ কমে যেতে পারে।
এছাড়া দীর্ঘক্ষণ যানজটে বসে থাকায় শিশুদের এনার্জি বা কর্মশক্তি হ্রাস পায়। তারা যেমন স্কুলে গিয়ে পড়াশোনার এনার্জি পায় না, বাসায় ফিরেও সেটা হারিয়ে ফেলে। সবমিলে এটা তাদের শিক্ষাজীবনে চরম ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে— যোগ করেন শারাবান তাহুরা।
যানজট শিশুর মনোজগতে যেমন প্রভাব ফেলে
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যানজটে বসে থাকাটা শিশুদের জন্য চরম বিরক্তিকর একটা অভিজ্ঞতা। মানুষ গতিশীল প্রাণী। মানুষ হয় হাঁটবে, না হয় ঘুমাবে। ছেলে-মেয়েরা যখন স্কুলে যেতে চাইবে তখন নির্দিষ্ট সময়ে তাকে স্কুলে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু যানজটে আটকে গেলে এটা সম্ভব হয় না। যানজট কতক্ষণে ছাড়বে, প্রতীক্ষাটা তাদের জন্য যেন মৃত্যুসমান!
তিনি বলেন, যানজটের কারণে শিশুরা যখন চরম অনিশ্চয়তায় থাকে তখন তাদের মধ্যে বিরক্তি ও ক্ষোভ তৈরি হয়। সেটা তাদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত করে। একসময় তারা অল্পতেই রেগে যায়, উগ্র ও সহিংস আচরণ করে। আবেগতাড়িত হয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন কার্যকলাপ বেড়ে যায়। প্রতিদিন যানজটে পড়লে তাদের মধ্যে হতাশাও তৈরি হয়। ফলে তারা সব বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব দেখায়।
যানজটে পড়াশোনার ক্ষতির কথা উল্লেখ করে এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, যানজটের কারণে অনেক সময় শিশুরা ক্লাস মিস করে। এতে তাদের পড়াশোনায় ঘাটতি হয়, অনেক সময় তারা সেটা পুষিয়ে নিতে পারে না। একপর্যায়ে পড়াশোনা, পরীক্ষা ও স্কুল তাদের জন্য একটা ভীতি ও আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়। এর প্রভাবে পড়াশোনা ও স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে শিশুরা।
শিশুদের স্নায়ুচাপ, মাথা ও শরীর ব্যথার কারণ যানজট : গবেষণা
সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে ইউনিভার্সিটি অব নর্দার্ন ফিলিপিন্স। তারা সেখানে উল্লেখ করেছে, দেশটির শিশুদের স্নায়ুচাপের প্রধান কারণ যানজট। এ কারণে তারা নির্ধারিত সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে পারে না। সেখান থেকেই চাপ শুরু। যানজটের কারণে অধিকাংশ শিশু স্কুলের প্রথম ক্লাসের পড়াশোনা ভালোমতো আয়ত্ত করতে পারে না। যা তাদের পরীক্ষার ফলে প্রভাব ফেলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, যানজটের কারণে ঢাকা শহরের মানুষের ৫৫ শতাংশ সময় নষ্ট হয়। পাশাপাশি ৫০ ভাগ শিশু মাথাব্যথায় আক্রান্ত হয়। ১৭ ভাগ শিশুর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা অনুভূত হয়। ৩৩ শতাংশ শিশু অতিরিক্ত ঘামের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়
যানজটের প্রভাব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেছে। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম ‘পসিবল কজেজ অ্যান্ড সলিউশন্স অব ট্র্যাফিক জ্যাম অ্যান্ড দেয়ার ইম্প্যাক্ট অন দ্যা ইকোনমি অব ঢাকা সিটি’।
এতে বলা হয়েছে, যানজটের কারণে ঢাকা শহরের মানুষের ৫৫ শতাংশ সময় নষ্ট হয়। পাশাপাশি ৫০ ভাগ শিশু মাথাব্যথায় আক্রান্ত হয়। ১৭ ভাগ শিশুর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা অনুভূত হয়। ৩৩ শতাংশ শিশু অতিরিক্ত ঘামের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়।
শিশুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানজট শিশুদের মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি শারীরিক ক্ষতিও করে। দীর্ঘক্ষণ যানজটে বসে থাকতে থাকতে শিশুদের কারও মেরুদণ্ড একটু বাঁকাও হতে পারে। আক্রান্ত হতে পারে শ্বাসতন্ত্র, স্নায়ু, মস্তিষ্ক ও কান। মানসিক চাপজনিত নানা অসুখে ভুগতে পারে তারা। এছাড়া শিশুদের স্বাভাবিক পাঠক্রমেও ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে যানজট।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থপেডিক চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ও এফ জি কিবরিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, যানজটের কারণে শিশুদের হাড়ে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুরা যখন গাড়িতে দীর্ঘ সময় বসে থাকে তখন তাদের মেরুদণ্ডে চাপ পড়ে। ফলে পিঠ ও কোমর-ব্যথার মতো সমস্যা প্রকট হয়।
পুরান ঢাকার আহমেদ বাওয়ানী একাডেমির অভিভাবক ফোরামের সদস্য দাউদ হোসাইন রনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের সন্তানরা বাসায় বসে অনলাইনে ক্লাস করছে। হঠাৎ করে স্কুল খোলায় এমনিতে অভ্যস্ত হতে সময় লাগছে তাদের। তার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে যানজট। স্কুল যাওয়া তো দূরের কথা, যানজটের ভয়ে তারা আত্মীয়-স্বজন বা কারও বাসায় বেড়াতে যেতে চায় না। তাদের মধ্যে যানজটভীতি তৈরি হয়েছে, যা তাদের অসামাজিক হতে বাধ্য করছে। সরকারের উচিৎ আগামীর ভবিষ্যৎ এই শিশুদের জন্য যানজট নিরসনে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এ বিষয়ে সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক (চাইল্ড প্রটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস গর্ভন্যান্স) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমাদের শিশুদের স্কুলের সময়সীমা ও যানজটের অবস্থা বিবেচনা করা দরকার। অফিসের সময়সীমা ও স্কুলের সময় নির্ধারণের আগে শিশুদের সর্বাত্মক স্বার্থ রক্ষা হয় কি না তা ভেবে দেখা দরকার। চাকরিজীবী বা অন্যান্য শ্রেণীর নাগরিকদের সুবিধা দিতে গিয়ে শিশুদের সুবিধাগুলোতে মনোযোগ দেওয়া হয় না। তবে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে শিশুর স্বার্থ দেখতে হবে।
তিনি বলেন, অধিকাংশ স্কুলে যে ধরনের অবকাঠামো থাকার কথা, তা নেই। স্কুলগুলো প্রায় বাসা বাড়ির মতোই। ফলে সবমিলিয়ে প্রতিদিন সকালে দীর্ঘ সময় যানজট পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে শিশুরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তাই স্কুলের অবকাঠামোতে পরিবর্তন আনা দরকার। এ ছাড়া, যেখানে যেখানে সম্ভব স্কুলবাসের ব্যবস্থা করা উচিত। কারণ স্কুলবাস যে যানজট নিরসন করে তা না, ছেলে-মেয়েদের এক সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠে। এক সঙ্গে কাজ করা ও আলাপ আলোচনা করার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় স্কুলবাস। উন্নত সব দেশে কিন্তু স্কুলবাস শিক্ষার্থীদের নিয়ে যায়, আবার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়।
এআর/এমএআর/