অতিরিক্ত দায়িত্বে ‘চাপে’ আইএমইডি, শুনছে না জনপ্রশাসন
সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের তালিকায় রয়েছে ৮টি প্রকল্প। এর মধ্যে পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট, মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ি আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ারের মতো পাঁচটি মেগা প্রকল্পই দেখভাল করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) দুটি সেক্টর। অভিযোগ উঠেছে, এসব প্রকল্প ‘অতিরিক্ত দায়িত্বে’ দেখভাল করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে বারবার জনবল চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রকল্পগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান আইএমইডির সেক্টর- ১ (শিল্প ও শক্তি) এর মহাপরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন এক বছর ধরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে বারবার জনবল চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রকল্পগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে
জানা যায়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান আইএমইডির সেক্টর- ১ (শিল্প ও শক্তি) এর মহাপরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন এক বছর ধরে। সেক্টর- ৮ এর মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এস এম হামিদুল হকও এক বছরের বেশি সময় ধরে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সেক্টর- ২ এর দায়িত্বে আছেন।
বিজ্ঞাপন
আইএমইডির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ মেগা প্রকল্পযুক্ত সেক্টর- ১ ও সেক্টর- ২ এর অতিরিক্ত দায়িত্ব কীভাবে এক বছরের বেশি সময় ধরে পালন করছে— তা সংশ্লিষ্টদের মনে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। চলতি অর্থবছরে সারাদেশে চলমান আইএমইডির তালিকাভুক্ত এক হাজার ৫৮২টি উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না— সেগুলো দেখভাল করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সরকারকে অবহিত করে আইএমইডি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইএমইডির কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে জানান, প্রত্যেক বিভাগেরই প্রশাসন শাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রশাসন শাখার প্রধানই বিভাগের সচিবকে সামগ্রিকভাবে সহযোগিতা করেন। আইএমইডির অতিরিক্ত সচিব ও সেক্টর- ৮ এর ডিজি থাকা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলো ‘অতিরিক্ত দায়িত্বে’ পরিচালনা করা হচ্ছে। আইএমইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আরও জানান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে বারবার জনবল চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রকল্পগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি অতিরিক্ত সচিব ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামানকে দুই সেক্টরের দায়িত্ব দিয়ে আদেশ জারি করে আইএমইডি। আইএমইডির তৎকালীন উপ-সচিব মোহাম্মদ আরিফুর রহমানের সই করা এক আদেশে বলা হয়, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের দাপ্তরিক কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের নিমিত্তে অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামানকে তার নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর- ১ (শিল্প ও শক্তি) এর প্রধান/মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হলো। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এ আদেশ জারি করা হলো এবং তা অবিলম্বে কার্যকর হবে।
ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান আইএমইডির সব প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আটটি বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্প দেখভাল করেন সেক্টর- ১ এর প্রধান হিসেবে। বিভাগগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের ৭৫টি, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ২৮টি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাতটি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৩টি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আটটি, আইন ও বিচার বিভাগের ছয়টি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ১২টি এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের দুটি প্রকল্প রয়েছে। সেক্টর- ১ এর আটটি বিভাগে মোট ১৫১টি প্রকল্প চলমান।
অন্যদিকে, সেক্টর- ৮ এর মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এস এম হামিদুল হকও নিজ দায়িত্বের বাইরে সেক্টর- ২ এর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ১৮২টি, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ৩৬টি, সেতু বিভাগের নয়টি, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাতটি, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের তিনটি, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের চারটি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুটি প্রকল্প রয়েছে। সেক্টর- ২ এর সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ২৪৩টি প্রকল্প রয়েছে। এই দুই সেক্টরের মোট ৩৯৪টি প্রকল্প অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে চলছে।
কেন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন— জানতে চাইলে আইএমইডির অতিরিক্ত সচিব ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আমরা প্রতি মাসে শূন্য পদ পূরণে চিঠি দিই। সর্বশেষ আইএমইডির সচিব ডিও লেটারও দিয়েছেন। গত মাসেও আমরা শূন্য পদ পূরণে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু জনপ্রশাসন থেকে এখানে কোনো পদায়ন দেওয়া হয়নি। জনপ্রশাসন থেকে কর্মকর্তা না দেওয়ায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি।’
চিঠি দেওয়ার পরও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কেন কর্মকর্তা দিচ্ছে না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আইএমইডি থেকে আমরা ক্রমাগত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিচ্ছি। এখন জনপ্রশাসন কেন দিচ্ছে না, সেটা তো আমার বলা শোভনীয় হবে না। এটা তারাই ভালো বলতে পারবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত এক বছরে শূন্য পদ পূরণে জনপ্রশাসনের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঁচ থেকে ছয়টি চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতি মাসে তাদের স্টেটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেও তারা কোনো জবাব দিচ্ছে না। আমাদের নতুন সচিব আসার পরও জনপ্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
অতিরিক্ত দায়িত্বে অসুবিধা হচ্ছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে গাজী মো. সাইফুজ্জামান বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই বেশি কাজ করতে হচ্ছে। সরকার দায়িত্ব দিলে তো আমরা না বলতে পারি না। তাই বেশি চাপ নিতে হচ্ছে। আইএমইডিতে সেক্টর- ৮ এর ডিজিও অতিরিক্ত হিসেবে সেক্টর- ২ এর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই দুটি সেক্টরের দায়িত্ব এক বছরের বেশি সময় ধরে পালন করছেন। এর আগে আমাদের ডিজি মজিদ স্যার ও আবজাল স্যারও দুটি করে সেক্টরের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আইএমইডির মোট সেট-আপে যে সংখ্যক কর্মকর্তা থাকার কথা, সেখানে অনেক পদ খালি আছে। ডিজির নিচের দিকে ডিডি ও এডিরও অনেক পদ খালি। পদগুলো কখনই শতভাগ থাকে না।’
তিনি বলেন, ‘এবারের বাজেটে দুই লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) রাখা হয়েছে। এর বিপরীতে এক হাজার ৫৮২টি প্রকল্প চলমান। প্রকল্পগুলো নিবিড় পরিবীক্ষণ করতে হলে আমাদের জনবল বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কারণ, সুষ্ঠুভাবে পরিবীক্ষণ হলে সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে এবং সরকার যে লক্ষ্যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে, তা অর্জিত হবে। কিন্তু এখানে কর্মকর্তা কম থাকলে নিবিড় পরিবীক্ষণটা ব্যাহত হবে। বিষয়টি বিবেচনা করে আমাদের পক্ষ থেকে জনবল বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব দেওয়া আছে। পরিকল্পনামন্ত্রীর পরামর্শে আমরা জনবল বাড়ানোর চেষ্টা করছি।’
এ প্রসঙ্গে জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আইএমইডি আমাদের চিঠি দিয়েছে। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত সম্ভব আমরা জনবল দিয়ে দেব।’
দীর্ঘদিন অতিরিক্ত দায়িত্বে প্রকল্প মনিটরিং করলে এর সঠিক সুফল সরকার তথা জনগণ পাবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটি বলা বাহুল্য; জনপ্রশাসনের বিষয়। মনিটরিং না হলে প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে যে সংশোধনগুলো করা যেত, সেগুলো হবে না। কারণ, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা কী করছে, সেগুলো না জানলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। আইএমইডির জনবল আছে কি না, বা যারা আছে তারা সঠিকভাবে কাজ করছে কি না— সেগুলো তো কেউ জানে না। পদ খালি থাকলে সেগুলো পূরণ করবে জনপ্রশাসন। কিন্তু যারা আছে, তাদেরও তো সঠিকভাবে কাজ করতে হবে।’
অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী আট সেক্টরে আটজন ডিজি থাকবেন। তবে অনেক সময় বদলিজনিত কারণে কর্মকর্তাদের পদ শূন্য থাকলে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এক বছর ধরে অতিরিক্ত দায়িত্বে সেক্টর চালানো ঠিক হয়নি। আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। অফিসে গিয়েই এ বিষয়ে আমি আইএমইডি সচিবের কাছে জানতে চাইব। সেক্টরের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনে দ্রুত সম্ভব নতুন ডিজি দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’
‘আমাদের সরকার উন্নয়নে বিশ্বাসী। দেশের উন্নয়নের জন্য আমরা ধারাবাহিকভাবে একনেকে নতুন নতুন প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছি। তবে গত বছর থেকে করোনা শুরু হলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি এসেছিল। ফলে অনেক প্রকল্প সংশোধন করতে হয়েছে বা হচ্ছে।’
এছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আইএমইডিকে শক্তিশালী করারও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আইএমইডির তদারকিতে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। এ লক্ষ্যে যেসব বাধা আছে, সেগুলো দ্রুতই সমাধান করব— বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।
এসআর/আরএইচ/এমএআর/