রাজধানীর ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) এক ছাত্রীর রহস্যজনক মৃত্যুর পর তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই ছাত্রীর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এছাড়াও দেহের সংবেদনশীল অংশগুলোতেও পাওয়া যায়নি জোরপূর্বক সঙ্গমের কোনো আলামত।

ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জানা গেলেও এর পেছনে মূলত কারা ছিল তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। ভিকটিমকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে না-কি মদ্যপানে বিষক্রিয়া পর সে মারা গেছে, তাও এখনো স্পষ্ট নয়। যার মাধ্যমে এ রহস্যগুলো পরিষ্কার হত সে নেহা ও তার বন্ধুর কোনো হদিসই পাচ্ছে না পুলিশ। ভিকটিমের মারা যাওয়ার তিনদিন হয়ে গেলেও নেহা ও তার বন্ধু রাজধানীর কোনো এলাকায় থাকতো তা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নেহার অস্তিত্ব নিয়ে রহস্য বাড়ছে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে।

এদিকে নেহা ও তার বন্ধুর খোঁজ না পাওয়া গেলেও এ ঘটনায় নিহত আরাফাতের কবরের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ । রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের পাশে তাকে কবর দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি রাজধানীর ধানমন্ডির সিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরাফাত। ধারণা করা হচ্ছে মদ্যপানে বিষক্রিয়ায় সে মারা গেছে।

মঙ্গলবার (৩ ফেব্রুয়ারি) ইউল্যাব শিক্ষার্থীর ধর্ষণকাণ্ডের মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা তথ্যগুলো জানান।

খোঁজ নেই নেহা ও তার বন্ধুর

পুলিশ বলছে, প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল নেহার বাসা রাজধানীর মিরপুরে। কিন্তু সেখানে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি তার বাবা, মা এবং স্থায়ী ঠিকানা কিছুই এখনও জানতে পারেনি পুলিশ। আর নেহাকে না পাওয়ায়, অধরা তার ছেলে বন্ধুও। ঘটনার দিন মদপান করে নেহাও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার খবর থাকলেও, এরপর আর পুলিশ তার কোনো খোঁজ পায়নি।

এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল লতিফ বলেন, আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে। তবে তদন্তে স্বার্থে আমাদের নেহা ও তার বন্ধুকে গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন। কিন্তু তাদের কোনো হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না। তার ঠিকানার সঠিক তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি। আশা করি দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করতে পারব।

আরাফাতের কবরের সন্ধান

মদ্যপানের পার্টির আয়োজকদের মধ্যে আরাফাত অন্যতম ছিল। সে রায়হান ও ভিকটিমকে নিয়ে ওই রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। পরে সে গুলশান-২ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আসে আর সেখানে নেমে যায়।

তদন্ত কর্মকর্তার দেওয়ার সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, সোমবার (২ ফেব্রুয়ারি) রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের পাশে আরাফাতকে কবর দেওয়া হয়েছে বলে জানতে পারে পুলিশ। এ বিষয়ে আরাফাতের পরিবারকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মামলার প্রয়োজনে আরাফাতের মরদেহ কবর থেকে তোলাও হতে পারে।

ঘটনার প্রতিচ্ছবি

গ্রেপ্তার মর্তুজা রাহয়ান চৌধুরী ও নুহাত আলম তাফসিরকে জিজ্ঞাসাবাদ ও পুলিশি তদন্তে ঘটনার একটি প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। তাদের তথ্য মতে, নিহত তরুণী ও রায়হানের মধ্যে আগে থেকেই প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ২৮ তারিখ বিকেলে দেখা করার পরিকল্পনা তাদের আগে থেকেই ছিল। এদিন বিকেলে তারা হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজার সামনে একত্রিত হয়। সেখানে আরাফাতের সঙ্গে তাদের দেখা হয়। আরাফাত তাদের গুলশানে একটি রেস্টুরেন্টে দাওয়াত আছে বলে নিমন্ত্রণ দেন। সে দাওয়াতে যাওয়ার জন্য তারা প্রথমে আরাফাতের বাসায় যান। সেখান থেকে একযোগে উবার নেন। শেষ মুহূর্তে আরাফাত তাদের জানায়, রেস্টুরেন্টের লোকেশন একটু বদল হয়েছে, উত্তরায় যাচ্ছি আমরা। তখন তারা উবার নিয়ে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ব্যাম্বুসুট রেস্টুরেন্টে যান।

রেস্টুরেন্টে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন ওই তরুণীর বন্ধু নেহা ও তার আরেক ছেলে বন্ধু। রেস্টুরেন্টে তারা ৫ জন একত্রীত হয়ে মদপান শুরু করেন। আর মদ সরবরাহ করে নেহার ওই ছেলে বন্ধু।

সন্ধ্যার পরপরই তারা একসঙ্গে মদ খাচ্ছিল। একপর্যায়ে নেহা অসুস্থ হয়ে রেস্টুরেন্টে বমি করে। তখন নেহা ও তার বন্ধু চলে যায়। রেস্টুরেন্টে আরাফাত, রায়হান ও ওই তরুণী মদপান করতেই থাকে। একপর্যায়ে নিহত তরুণীও বমি করে। সে অবস্থা দেখে রায়হান ও আরাফাত ওই তরুণীকে নিয়ে একসাথে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে একটি উবার নেয়। উবারে ওই তরুণী ও রায়হানকে গুলশান-২ এ নামিয়ে দেয় আরাফাত।

গুলশান-২ এ নেমে ওই তরুণী বাসায় যাবে না বলে, তাকে তার বান্ধবী তাফসিরের বাসায় নিয়ে যেতে বলে। তখন তারা দুইজন মিলে মোহাম্মদপুর হোমস লিমিটেডের ৯ নম্বর বিল্ডিংয়ের বাসায় যায়। সে বাসায় তাফসির তার মার সঙ্গে থাকতো। তবে সেদিন তাফসির একা ছিল। ২৮ তারিখ রাতে তারা তাফসিরের বাসায় ঢুকে। এর পরপরই ওই তরুণী বমি করে। সে বমি পরিষ্কার করে তাফসির ও রায়হান। এরপর রায়হান ও ভিকটিম তরুণীকে এক রুমে রেখে অন্য রুমে চলে যায় তাফসির।

রাতে রায়হানের সঙ্গে একাধিকবার ওই তরুণীর শারীরিক সম্পর্ক হয়। এরপর ২৯ তারিখ ভোরেই ভিকটিমকে তাফসিরের বাসায় রেখে রায়হান নিজের বাসায় চলে যায়। সকাল থেকে দুর্বল বোধ করছিলেন ভিকটিম তরুণী। দুপুরে তাফসিরের বাসায় এসে আবার খোঁজ খবর নিয়ে যায় রায়হান। শুক্রবার মধ্যরাতে রায়হান তার বন্ধু কোকোকে ফোন দিয়ে ভিকটিমের শারীরিক অসুস্থতার কথা জানায়। তখন কোকো এসে তাকে প্রথমে ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যায়।

তবে হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসিইউ সুবিধা না থাকায় ৪০ মিনিট পর তাকে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে আইসিইউতে রাখা হয় ভিকটিম তরুণীকে। তখন রায়হান ভিকটিমের বাবাকে ফোন করে এ বিষয়ে জানায়। ভিকটিমের বাবা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। পরদিন ৩০ তারিখ মধ্যরাতে নেহার মৃত্যুর আগেই তার বাবা থানায় এসে একটি মামলা করে। পরদিন ৩১ তারিখে তার মেয়ের মৃত্যু হয়।

তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা

এ ঘটনায় রায়হান এবং তাফসিরকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে এনেছে পুলিশ। এছাড়াও তাফসিরের বাসার, ব্যাম্বুশুটসহ বেশ কয়েকটি স্থানের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। বন্ধু কোকোসহ নিহত ও আসামিদের পরিবারের পরিবারের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মামলার আসামি আরেক আসামি নেহাকে গ্রেফতারে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ।

এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রায়হানের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি ইতোমধ্যে চেক করা হয়েছে। সেটি দেখে আমাদের মনে হয়েছে যে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত ছিল এবং এ বিষয়ে দুইজনই অবগত ছিলেন। বাকিদের মোবাইল ফোনগুলো সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। সেগুলোও প্রযুক্তিগত পরীক্ষা করা হবে। এটি মূলত একটি ড্রিংকস পার্টি ছিল (মদপানের)। পার্টি আয়োজনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য এখন পর্যন্ত তদন্তে পাইনি।

ওসি আরও বলেন, মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও ডিএনএ টেস্টের প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত জানা যাবে।

পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রওশানুল হক সৈকত ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গ্রেপ্তার দুইজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাদের দেওয়া তথ্য ও আমাদের অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি। এজাহারভুক্ত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

এ বিষয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদ বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে শুনেছি নেহার এক বন্ধু বিমানবন্দর থেকে মদ এনে উত্তরার ব্যাম্বুসুট রেস্টুরেন্টে খেয়েছে। আমরা সে ছেলের নাম পরিচয় এখনো পাইনি। তাকে খোঁজা হচ্ছে। মদপানের কারণেই কিছু হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এছাড়া মদপান করার কারণে বিষক্রিয়া হয়েছে কি-না তা আমরা তদন্ত করছি। এছাড়াও উত্তরার যে রেস্টুরেন্টে এ মদপান করা হয়েছিল, তাদের লাইসেন্স আছে কি-না তাও তদন্ত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, নিহত তরুণীর ভিসেরা নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি গ্রেপ্তার দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্তে প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হয়েছে, অতিরিক্ত মদ্যপান, মদে বিষক্রিয়া অথবা বেশি মদপান করিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পারে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে

ভিকটিমের বাবার করা নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় ৫ আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ওই তরুণীর বন্ধু মর্তুজা রায়হান চৌধুরীকে (২১) ধর্ষণকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অন্য চার আসামির মধ্যে তিনজন হলেন- নুহাত আলম তাফসির (২১), আরাফাত (২৮) ও নেহা (২৫)। আরেকজনের নাম জানা যায়নি। মামলায় অজ্ঞাত হিসেবে তাকে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, গত ২৮ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় মর্তুজা রায়হান ওই তরুণীকে মিরপুর থেকে আসামি আরাফাতের বাসায় যায়। আরাফাতের বাসায় স্কুটার রেখে ওই তরুণীসহ রায়হান, আরাফাত একসঙ্গে উবারে করে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ব্যাম্বুসুট রেস্টুরেন্টে যায়। সেখানে আগে থেকেই আরেক আসামি নেহাসহ ও আরও একজন সহপাঠী (তরুণ) উপস্থিত ছিল। সেখানে আসামিরা ওই তরুণীকে জোর করে ‘অধিক মাত্রায়’ মদপান করায়।

এজাহারে বলা হয়েছে, মদপানের একপর্যায়ে ভিকটিম অসুস্থ বোধ করলে রায়হান তাকে মোহাম্মদপুরে তার এক বান্ধবীর বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে নুহাতের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে ওই তরুণীকে একটি রুমে নিয়ে তারা সবাই একসাথে ছিল, এবং তাদের চোখের সামনে রায়হান তাকে ধর্ষণ করে।

ধর্ষণের পর রাতে ওই তরুণী অসুস্থ বোধ করে ও বমি করলে অসিম খান কোকো নামে তার আরেক বন্ধুকে ফোন দেয়। সেই বন্ধু পরদিন এসে ওই তরুণীকে প্রথমে ইবনে সিনা ও পরে আনোয়ার খান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে। ২ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর রোববার সে মারা যায়।

এজাহারে ধর্ষক হিসেবে মর্তুজা রায়হান চৌধুরীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বাকীদের ভূমিকা ‘জোর করে মদ পান করিয়ে ধর্ষণে সহযোগিতা’ উল্লেখ করা হয়েছে।

তরুণীর ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসক যা বলছেন

সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আ ম সেলিম রেজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়েটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে কি-না, তা জানতে নিহতের ভিসেরা আলামত নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও তার যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথ থেকে আলামত সংগ্রহ করে ডিএনএ টেস্টের জন্য পাঠানো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, নিহতের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এছাড়াও দেহের সংবেদনশীল অংশগুলোতেও জোরপূর্বক সঙ্গমের আলামত পাওয়া যায়নি।ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।

এমএসি/এমএইচএস