একজন নিভৃতচারী চিকিৎসক ও প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। বিনামূল্যে সহস্রাধিক কিডনি প্রতিস্থাপন করে শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। তবুও লেশমাত্র অহংকার নেই এ চিকিৎসকের। বরং সবসময় নিজেকে আড়ালে রাখতেই পছন্দ করেন। ব্যাতিক্রমি এ গুণী মানুষটি আনুষ্ঠানিকভাবে সহকর্মী, বন্ধুদের প্রশংসা আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন।

শুক্রবার (১৫ জানুয়ারি) রাতে অফিসার্স ক্লাব ঢাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে-৪০ ব্যাচের আয়োজনে এক অনুষ্ঠানে তাকে এ সম্মাননা জানানো হয়।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. কামরুলের একসময়ের সহপাঠী শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব ডা. মেজবাহ উদ্দিন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাসহ আরও অনেকেই।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্যে আমন্ত্রিত অতিথিদের উদ্দেশ্যে ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, আমি খুবই ক্ষুদ্র মানুষ। বক্তৃতার সময়ে আমার নামটি একবারে বেশি উচ্চারণ না করলে আমি খুবই খুশি হবো। আমি সবসময় চাই বাংলাদেশ যেন এগিয়ে যায়। দেশের জন্যই সবসময় কাজ করার চেষ্টা করেছি।

তিনি বলেন, যখনই কোনো দেশে গিয়েছি, উন্নত প্রযুক্তি ও চিকিৎসা যা দেখেছি, সেটি কীভাবে আমাদের দেশে নিয়ে আসা যায়, আমি সেই চেষ্টা করেছি। সবশেষে তিনি আবারও বলেন, দয়া করে কেউ আমার প্রশংসা করবেন না। দুনিয়াতেই যদি আমার কাজের সব সম্মান পেয়ে যাই, তাহলে পরকালে আল্লাহর থেকে কিছুই পাবো না।

অনুষ্ঠানে ডা. কামরুল প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি বলেন, আমরা স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ, কারণ এতো বড় একটা পৃথিবীতে তিনি আমাদের ডা. কামরুলের সাহচর্য পাওয়া, একইসঙ্গে ও একই ব্যাচে পড়ার সুযোগ দিয়েছেন। কামরুলের মতো হয়তো এতোটা গুণী আমরা নই, কিন্তু তার সঙ্গে একত্রে পড়াশোনা করা, একসঙ্গে চলার সুযোগ আমাদের হয়েছে।

তিনি বলেন, আমি ডাক্তার হয়েছি, কিন্তু একজন ভালো মানুষ হতে পেরেছি কি না আমার জানা নেই। কামরুল একজন ভালো ডাক্তার, কিন্তু তারচেয়েও বড়গুণ সে একজন ভালো মানুষ। পৃথিবীতে যতো যা ভালো কিছু আছে, তার সবকিছুই কামরুলের মধ্যে আছে। তারজন্য দোয়া করি স্রষ্টা যেন তাকে আরও অনেকদিন সচল রাখেন, সক্রিয় রাখেন। এখনকার মতোই যেন সে মানুষের সেবা করতে পারে, মানুষকে সুস্থ রাখতে পারে।

ডা. মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ডা. কামরুল এমন একজন মানুষ, যার প্রশংসা না করে বক্তৃতা দেওয়া কঠিন। কারণ পরিচয় হওয়ার পর তার যেসব কর্মকাণ্ড আমি দেখেছি, একজন মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষের যেসব গুণ থাকা দরকার, সবগুলোই তার মধ্যে রয়েছে। আমি মনে করি, একজন রোগীর প্রতি কামরুলের যে বিহেভিয়ার (আচরণ), তা প্রতিটি চিকিৎসকেরই থাকা উচিত।

তিনি বলেন, একজন চিকিৎসক রোগীর সামনে সবসময় হাসিমুখ নিয়ে থাকবেন। তিনি কখনই রোগীকে নিরুৎসাহিত নয়, উৎসাহিত করবেন।

মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ডা. কামরুল ঢাকা মেডিকেলের কে-ফোর্টি ব্যাচের গর্ব। আমরা তাকে নিয়ে সবসময় গর্ববোধ করি। আজকের এই অনুষ্ঠানটি করতে চাইলে শুরুতে কামরুলের একেবারেই অনীহা ছিল। তারপর আমি উদ্যোগী হয়ে তাকে রাজি করাই। তার কথা একটাই সে এতো মানুষের প্রশংসা পেতে কোন কাজ করেন না, আমরা যদি তাকে নিয়ে বেশি প্রশংসা করি, তাহলে আল্লাহ তার প্রতি নারাজ হবেন। সুতরাং আমরা বুঝতেই পারি সে কতোটা উদারমনা মানুষ।

অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করে অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ডা. কামরুল ছাত্র জীবনের আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল না। তখন সে আমাকে চিনতই কি না আমার সন্দেহ আছে। সে আমাদের বন্ধু হয়েছে এমবিবিএস পাস করার পরে। কারণ আমরা কামরুলকে পড়াশোনা আর স্মিত হাসি ছাড়া কখনই দেখিনি। বন্ধু হওয়ার জন্য যে আড্ডাটা দিতে হয়, সেটি কখনই সে দেয়নি। কারণ আমরা যখন আড্ডা দিতাম, তখন সে পড়াশোনা নিয়েই থাকতো।

‘তাছাড়া খালাম্মা হয়তো তাকে বলে দিয়েছিল যে, মেয়েদের সঙ্গে বেশি মিশবা না’ -মজার ছলে যোগ করেন ডা. ফ্লোরা। তিনি বলেন, পাস করার পর যখন কামরুল আমাদের সঙ্গে একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করলো, তখন আমরা খুবই অবাক হতাম এবং একজন আরেকজনকে বলতাম যে, কামরুল এখন গল্প করে।

ডা. ফ্লোরা বলেন, ছাত্র জীবনে আমরা রাজনীতি করেছি, অনেক মজা করেছি। অর্থাৎ তখন অনেক কিছুই করেছি পড়াশোনা বাদ দিয়ে, কিন্তু এই কামরুল বাকি কোন কিছুই করেনি, শুধু পড়াশোনা করেছে।

প্রসঙ্গত, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেখানে একজন কিডনি রোগীর চিকিৎসায় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা খরচ হয়, সেখানে নামমাত্র খরচে অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত সিকেডি হাসপাতালে কিডনি রোগের চিকিৎসা করা হয়। রোগী ও ডোনার, দুটো অপারেশনই করেন ডা. কামরুল ইসলাম। এতে ব্যক্তিগতভাবে এক টাকাও ফি/খরচ নেন না তিনি। ফলে রোগীর ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা সেভ হয়।

সিকেডি হাসপাতালের তথ্যমতে, ডা. কামরুল ইসলাম এক হাজার ৪৫টি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন।

এক নজরে ডা. কামরুল ইসলাম
অধ্যাপক কামরুল ইসলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে-৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১৯৮২ সালে তখনকার ৮টি মেডিকেল কলেজের সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। উচ্চশিক্ষাগ্রহণ করেন রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস অব এডিনবার্গ থেকে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবা আমিনুল ইসলাম পাকশী ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার 'অপরাধে' স্থানীয় রাজাকার ও বিহারীরা তাকে হত্যা করে।

অধ্যাপক কামরুল ১৯৯৩ সালে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন। তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। প্রথমবারের মতো সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ করেন ২০০৭ সালে। ২০১১ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে প্রতিষ্ঠা করেন সিকেডি হাসপাতাল। তিনি ২ কন্যা সন্তানের জনক।

টিআই/এসএম