ক্যামেরার কবি শিকদার আহমেদ : বাংলার রূপ তুলে ধরাই যার নেশা
রাজধানীর আর্মি গলফ ক্লাব। তৃতীয় তলায় পৌঁছে মনে হলো নাগরিক কোলাহল যেন দূরে পালিয়েছে। মিলনায়তনের দেয়ালে ঝুলছে গ্রামীণ প্রকৃতির একের পর এক ছবি। সেখানে ধরা পড়েছে গ্রামীণ সমাজের নানা মাত্রিক রূপ। প্রাচ্যের মনোরম ছবির পাশেই টাঙানো আছে পাশ্চাত্যের পটভূমিতে তোলা আলোকচিত্র। তাতে যেমন আছে প্রকৃতির রূপ-রস-আলোর রেখা, আছে ঐতিহ্যবাহী নানা স্থাপনার ছবিও।
এসব ছবি ইমেজ সেন্সরে যিনি ধরেছেন, সেই ক্যামেরার কবির নাম শিকদার আহমেদ (শিকদার মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ)। তার তোলা নান্দনিক ৬০টি ছবির এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘হয়্যার ইস্ট মিটস ওয়েস্ট’; সোজা বাংলায়- প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্মিলন। দুই দিনব্যাপী এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী আজ শুক্রবার (১৪ জানুয়ারি) বিকেলে শুরু হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ফটোগ্রাফার (আলোকচিত্রী) শিকদার আহমেদ আদতে একজন বৈমানিক। ২৫ বছর বয়সে বিমান চলাচল সংশ্লিষ্ট খাতে চাকরিজীবন শুরু করেন। আকাশে উড়তে উড়তে দেখেন মায়াবী পৃথিবী। মেঘের ভেলার ওপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে ভাবেন, পৃথিবীর সৌন্দর্য ফ্রেমবন্দি করে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা।
এভাবেই আলোকচিত্রের প্রতি ভালোলাগার জন্ম। রূপসী বাংলার রূপ ক্যামেরাবন্দি করাই লক্ষ্য— জানিয়ে আলোকচিত্রী শিকদার আহমেদ বলেন, ছবি তুলতে গিয়ে অনেক সময় ঘুমাতে পারিনি। হয়তো বিমানে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে নেমেছি, সবাই বিমান থেকে নামার পর আমি ক্যামেরা হাতে চলে গেছি। ফটোগ্রাফি ও বিমান চালানোর মধ্যে সমন্বয় করতে হয়েছে।
মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন থাকাকালে ফটোগ্রাফি শুরু করেন— জানিয়ে তিনি বলেন, বিমান চালিয়ে নানা দেশ ভ্রমণ করেছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছবি তুলেছি। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে নতুন করে আবিষ্কার করেছি জগৎ ও জীবন। আমার পাশ্চাত্যের আলোকচিত্রে মানুষের উপস্থিতি কম, প্রাচ্যের ছবিতে বেশি। আমি যেভাবে দেখি সেভাবেই দেখাতে চাই, তাই ছবি তুলে তা এডিট করিনি।
বিশ্বের ৫২টি দেশের ১৫০ জায়গায় গিয়েছেন এই ফটোগ্রাফার। সেসব স্থানের নানা চিত্র ফ্রেমবন্দি করতে করতে একপর্যায়ে ফটোগ্রাফির নেশায় মেতে ওঠেন তিনি। ইতিহাস-ঐতিহ্য, সামাজিক, প্রাকৃতিক ও মানবিক উপাদানে ভরপুর এসব ছবির রয়েছে পৃথক পৃথক অন্তর্নিহিত গল্প।
শিকদার আহমেদের তোলা আলোকচিত্রের এই প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, আলোকচিত্রী শিকদার আহমেদ আমাদের কাছে আহমেদ ভাই নামে পরিচিত। তিনি ভালো মানুষ, পরোপকারী মানুষ। দুই বছর তাকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি সহকর্মী হিসেবে। ইউএস-বাংলা এয়ার লাইন্সের উন্নয়নে কাজ করেছেন। তার কাছ থেকে শুধু সহযোগিতাই পেয়েছি।
তিনি বলেন, করোনাকালে ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমি ও আহমেদ ভাই বিপদে আটকে পড়া প্রবাসীদের দেশে আনতে পেরেছি। আমরা এক রকম যুদ্ধ করেছি। তিনি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সকে নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করেন।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমার নেশা কাজ করা। আমি কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। আহমেদ ভাই আমেরিকায় বসবাস করেন। দুই বছর পাশে থেকেও জানতে পারিনি তিনি ছবি তোলেন। তিনি কখনও বলেননি। এই অনুষ্ঠানে আসার ক্ষেত্রে তার প্রতি ভালোবাসা থেকে আমি ‘না’ বলতে পারিনি।
প্রধান অতিথি আব্দুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, দুই দশকে বাংলাদেশের ৯০০ আলোকচিত্রী দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোকচিত্রের বিষয়ে পাঠদান করা যায়। আমি আহমেদ ভাইকে বলব, গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে এই বিষয়ে তিন মাসের সার্টিফিকেট কোর্স চালু করা যায়।
তিনি বলেন, আহমেদ শিকদারের ফটোগ্রাফি আমি দেখেছি, এগুলো ইউনিক। তিনি বাংলাদেশকে অনেক সম্মান এনে দেবেন। এখন দরকার তাকে তুলে ধরা। আমি ইউএস-বাংলার সংশ্লিষ্টদের বলব, তার তোলা ছবি ব্যবহার করে ক্যালেন্ডার করার জন্য।
অনুষ্ঠানে আলোকচিত্রী শিকদার আহমেদের ৭৫ বছর বয়সী মা হাসিনা শিকদারও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, আমার ছেলের মেধা আপনারা মূল্যায়ন করছেন, এজন্য ধন্যবাদ। আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।
আলোকচিত্রী শিকদার আহমেদ বলেন, আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আব্দুল্লাহ আল মামুন স্বপ্নবাজ মানুষ। আমার বিশ্বাস, যতই দিন যাবে ইউএস-বাংলা ততই বাংলাদেশের গর্বের কারণ হবে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন লুবনান ট্রেড কনসোর্টিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হক খান। তিনি বলেন, শীতের বিকেলে এটি সুন্দর আয়োজন। শিল্প ও মননশীলতা আজ অনেকটা উধাও হয়ে গেছে। সেখানে এমন উদ্যোগ দারুণ প্রশংসনীয়। সবাই বাস্তব বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু শিল্প হৃদয়ের ব্যাপার।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিপুণ উপস্থাপনার মাধ্যমে সবার মন জয় করেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম।
পিএসডি/এজেড/এইচকে