সাকরাইন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। এ উৎসবকে ঘিরে প্রায় একমাস আগে থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। বিশেষ করে এ এলাকার দোকানিদের ঘুড়ি এবং ফানুস বানানোর তোড়জোড় শুরু হয়। তবে গত কয়েক বছর করোনার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ উৎসবের চিত্র অনেকটা বদলে গেছে। 

গত মাস থেকে করোনার বিস্তার আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকায় সরকার ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করেছে। ফলে এবারও এ ঐতিহ্যবাহী উৎসব পালনে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তারওপর ইংরেজি নববর্ষের সময় ফানুস ওড়ানোর ফলে বেশ কয়েকস্থানে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এতে বেশ আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

এছাড়া আতশবাজির বিকট শব্দে হৃদরোগে আক্রান্ত তানজীম উমায়ের নামে ৪ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছিল বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। এ মৃত্যুর ঘটনা এবং একাধিক অগ্নিকাণ্ড ঘটায় ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধের দাবি ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) সরেজমিনে পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এখানকার প্রতিটা দোকানেই ঝুলছে ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের ঘুড়ি। তবে সহজে মিলছে না ফানুস। দোকানিরা বলছেন, থানাপুলিশ ফানুস বিক্রি করতে নিষেধ করেছে। এলাকায় মাইকিংও করেছে। তাই তারা প্রকাশ্যে ফানুস বিক্রি করছেন না। তবে কেউ চাইলে তার কাছে কৌশলে বিক্রি করা হচ্ছে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দামে। এই ফানুস এবং আতশবাজি নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে অনেকটা চোর-পুলিশ খেলার মতো পরিস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। অনেক দোকানি ক্রেতাকে পুলিশের লোক ভেবে ফানুস থাকার কথা স্বীকার করেন না। তবে কথা-বার্তা আসল ক্রেতা নিশ্চিত হলে কেউ কেউ প্রতি পিস ১০০ থেকে ১২০ টাকা দামেও বিক্রি করছে।

এবার থার্টি-ফার্স্ট নাইটে ঢাকাবাসীকে ভুগিয়েছে ফানুস। এ উদযাপন শুরুর কিছু সময়ের মধ্যে ঘটে যায় অনেকগুলো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে সারা দেশ থেকে প্রায় ২০০টি অগ্নিকাণ্ডের খবর আসে। ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারে, এসব অগ্নিকাণ্ডের বেশিরভাগ ঘটেছে ফানুসের কারণে। কয়েকটি আগুন আতশবাজির কারণেও লেগেছে।

এবিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রধান এবং স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, সাকরাইন ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। ঘুড়ি ওড়ানোর পাশাপাশি এই উৎসবে ফানুস ওড়ানো এবং আতশবাজি ফোটানোসহ শব্দ ও বায়ু দূষণকারী নানান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এটি দেশের প্রচলিত পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় সুস্পষ্ট অপরাধ হলেও দূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না।

তিনি বলেন, অযথা শব্দ ও বায়ু দূষণ করা আইনত নিষিদ্ধ থাকার পরও প্রশাসনের নীরব ভূমিকার কারণে গত ৩১ ডিসেম্বর থার্টি-ফার্স্ট নাইট এবং বর্ষবরণে অতিরিক্ত মাত্রায় পৌঁছেছে। যা উৎসবকে সন্ত্রাসের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এতে ভীত হয়ে একটি শিশুর প্রাণ ঝরেছে, আগুনে সর্বস্ব হারিয়েছে অনেকে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো এসব দেখেও কিছুই না জানার ভাব করে আছে পরিবেশ অধিদফতরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের নীরবতার সুযোগে ক্রমশ বেড়ে চলেছে উৎসবের নামে শব্দ সন্ত্রাস। গত ৫ বছর ধরে জাতীয় উৎসব-কেন্দ্রিক শব্দ ও বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ করে আসছে ক্যাপস। এতে নিশ্চুপ ভূমিকায় না থেকে সাকরাইন উৎসবের আগেই আতশবাজি ফোটানো এবং ফানুস ওড়ানো বন্ধের দাবি জানান। একইসঙ্গে অন্তত জনস্বাস্থ্যের বিবেচনায় বিয়ে অনুষ্ঠানসহ সব ধরনের উৎসবে আতশবাজি ফোটানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এর ক্রেতা ও বিক্রেতাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান এ বায়ুমান গবেষক।

সাকরাইনে ফানুস ওড়ানো ও আতশবাজি ফুটানোর বিধি-নিষেধ বিষয়ে সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মইনুল ইসলাম বলেন, সাধারণত পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে এসব বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এরকম নির্দেশনা পেলে আমরা ফানুস ওড়ানো প্রতিরোধের চেষ্টা করবো। এবার ওমিক্রন সতর্কতায় সাকরাইনে যাতে কোনো ধরনের জনসমাগম না ঘটে সে দিকে আমরা সজাগ থাকব।

এমটি/এসএম