বাজির শব্দে তছনছ হয়ে যায় রেমিনের জীবন
‘আমার মেয়েটা ছিল দারুণ মেধাবী। ক্লাস ফাইভ আর এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। এসএসসি পাস করেছিল গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে। আমার সেই সোনার টুকরো মেয়ে এখন অনেক আপনজনকেই চিনতে পারে না। নিছক আনন্দের জন্য কিছু মানুষের ফোটানো বাজির শব্দে ভয় পেয়ে ব্রেইন স্ট্রোক করে সে। এরপর হয়ে যায় প্যারালাইজড। এখন তার সারা দিনের সঙ্গী বিছানা।’
মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) এভাবেই ঢাকা পোস্টের কাছে দুঃসহ অনুভূতি প্রকাশ করেন জাহিদ রিপন নামের এক বাবা। প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া তার আদরের মেয়েটির নাম শারমিন জামান রেমিন।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন : থার্টি ফার্স্টে বাজির শব্দে কাঁপছিল শিশুটি, পরদিন মৃত্যু
ঘটনা ফরিদপুর শহরের পূর্ব খাবাসপুরের, ২০১৭ সালের জুন মাসে। তখন ছিল রমজান মাস। আর দু-চারদিন পরেই ঈদ। সেই খুশিতে কারা যেন বাসার পাশে বাজি ফোটাতে শুরু করে। তখন রাতের প্রথম প্রহর। বাজির তীব্র শব্দ এসে আঘাত করে বাবার পাশে ঘরে বসে থাকা রেমিনের মস্তিষ্কে।
আক্ষেপ জাহিদ রিপন বলেন, ‘একটি বাজির শব্দ আমার পরিবারের জন্য এলো সারা জীবনের কান্না হয়ে। বাজির শব্দে তছনছ হয়ে গেছে আমার সোনার টুকরো মেয়েটার জীবন।’
রেমিনের বাবা জাহিদ রিপন একজন গণমাধ্যমকর্মী। তিনি বলেন, ‘বাজির ঘটনার পর ধীরে ধীরে রেমিনের শরীরের একপাশ পুরো প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো তার ডান হাত আর ডান পা প্যারালাইজড। ধরে ধরে হাঁটাচলা করাতে হয়।’
এক সময় চারপাশ মুখরিত করে রাখা রেমিন দুর্ঘটনার সাড়ে চার বছর পরও তেমন কথা বলতে পারে না বলে জানান জাহিদ রিপন। তিনি বলেন, ‘এখনো সে মানুষ চেনে কম। আমরা যারা কাছে থাকি তাদের ছাড়া অন্যদের চিনতে কষ্ট হয়। স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল, তেমন কিছুই মনে থাকে না।’
রেমিনের চাচা সোহাগ জামান বলেন, ‘ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে রেমিন স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হয়েছিল দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজে। তার স্বপ্ন ছিল সাংবাদিকতা নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করবে। কর্মজীবনে বাবার মতো বেছে নেবে সাংবাদিকতাকে। দশের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের সেবা করবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন বাজির শব্দে গুঁড়ো হয়ে গেছে। সেবার রেমিনের ঈদ কেটেছে হাসপাতালের বেডে।’
আরও পড়ুন- ফানুস ওড়ানো : উৎসবের আগুনে ঝরছে কান্না
তিনি বলেন, ‘সুস্থ থাকলে এতদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখত রেমিন। নিজেকে প্রস্তুত করতে পারত দেশসেবার জন্য। জীবনের ছবি হতো আলোকোজ্জ্বল। কিন্তু এখন তার সময় কাটে বিছানায় শুয়ে-বসে। জীবন থমকে গেছে।’
সোহাগ জামান বলেন, ‘তবে ফরিদপুরে আনন্দ-উল্লাসের অমানবিক প্রক্রিয়া এখনো চলছে। এখনো নিউ ইয়ার, ঈদ-পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে কারণে-অকারণে বাজি ফোটানো হচ্ছে। আতশবাজি, ফানুস আর শব্দ দূষণ করে মাঝরাতে উচ্চ ভলিউমে গান বাজানো- এসব ভোগান্তি যেন পিছু ছাড়ার নয়।’
‘একজনের আনন্দ আরেক জনের সারা জীবনের কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখন সময় এসেছে এ বিষয়টাতে গুরুত্ব সহকারে নজর দেওয়ার’, বলেন সোহাগ জামান।
রেমিনের বাবা জাহিদ রিপন বলেন, ‘ছেলেবেলা থেকেই রেমিন একটু ভীতু ছিল। বেশি শব্দে বিরক্ত হতো, ভয় পেত। কিন্তু বাজির ঘটনার পর মেয়েটা এখন জোরে শোনা যায় এমন কোনো শব্দই আর নিতে পারে না। ফরিদপুর শহরের পূর্ব খাবাসপুরে আমাদের যে বাড়ি, তার পাশেই রাস্তা। নৈঃশব্দ্য বলে কিছু নেই এখানে। মেয়েটা এখানে থাকতে চায় না। তাই জমি বিক্রি করে শহরের বাইরে মুন্সিবাজারে গ্রামের দিকে জমি কিনেছি। শব্দ দূষণের হাত থেকে বাঁচতে সেখানে বাড়ির কাজ শুরু করেছি।’
তিনি বলেন, ‘শহর ছেড়ে যেতে আমাদের নানা সমস্যা হবে। কিন্তু তবু যাব, তাতে যদি মেয়েটা একটু স্বস্তি পায়। আমার ক্লাস নাইন পড়ুয়া একটি ছেলে আছে, সেও হয়ত ভালো থাকবে।’
রেমিনের চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহিদ রিপন বলেন, ‘চিকিৎসা চলছে, কিন্তু গত দুই বছর ধরে সেভাবে উন্নতি নেই।’
তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর মেয়েকে তখন ফরিদপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখিয়েছিলাম। পরে ঢাকায় এসে প্রফেসর ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদের অধীনে চিকিৎসা করাই। এরপর ভারতের ভেলোরে ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ (সিএমসি) হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে যে ডাক্তারের কাছে যাই, গিয়ে শুনি তিনি ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি ডা. আরি জর্জ চাকো। দেশে ফিরে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে তার অধীনে রেমিনের অপারেশন করাই। বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে। লাখ লাখ টাকা খরচ করছি। কিন্তু দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পরও আমার মেয়েটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি।’
‘ডাক্তাররা বলেন মেয়ে ভালো হয়ে যাবে। তবে সময় লাগবে। কতদিন লাগবে তা কেউ বলতে পারেন না। তারা বলেছেন, এখন রেমিনের ইচ্ছাই সব। সে যা চায়, যা বলে সেভাবেই চলার পরামর্শ দিয়েছেন আমাকে। মেয়ে যদি বলে এখন রাত তাহলে রাত, দিন বললে দিন।’
রেমিনের বাবা বলেন, ‘নতুন যে বাড়ি করছি তার ডিজাইন রেমিনের পছন্দে। সে চায় বাড়িতে সুন্দর বাগান থাকবে, হরিণ থাকবে, পুকুর থাকবে। মেয়ের জন্য একটি পুকুর কেটেছি। কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আমি সামর্থ্যের শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করতে চাই যেন মেয়েটা ভালো থাকে।’
শারমিন জামান রেমিনের চিকিৎসার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, সে মোয়ামোয়া নামক একটি বিরল রোগে আক্রান্ত। বাজির ঘটনার পাঁচ বছর আগে থেকে তার এই রোগের লক্ষ্মণ প্রকাশ পাচ্ছিল। এ রোগে মস্তিষ্কের ধমনি সরু বা অবরুদ্ধ হয়ে যায়। তা থেকে খিঁচুনি এবং ইসকেমিক স্ট্রোক (রক্ত জমাট বেঁধে স্ট্রোক) ও রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক হতে পারে।
২০১৭ সালের ৪ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কয়ার হাসপাতালে ডা. আরি জর্জ চাকোর অধীনে ছিল রেমিন। সে সময় রেমিনের ডিসচার্জ সামারিতে (হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় লেখা রোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণ) উল্লেখ করা হয়েছে, তার শরীরের ডান দিকে পাঁচ বছর ধরে ব্যথা ছিল।
শব্দের কারণে স্ট্রোক হয়েছিল কি না যদিও রেমিনের চিকিৎসাপত্রে তা উল্লেখ নেই, তবে মোয়ামোয়া আক্রান্ত রেমিনের পরিবার মনে করে, বাজির শব্দে ভয় পেয়ে স্ট্রোক করেছিল সে। একজন মোয়ামোয়া রোগীর জন্য হঠাৎ ধেয়ে আসা বাজির শব্দ ছিল বোমার আঘাতের মতোই তীব্র।
এইচকে/জেএস