মহাকালের অমোঘ নিয়মে বিদায়ের ঘণ্টা বেজেছে ২০২১ সালের। পূর্বাকাশে রক্তিম সূর্য নিয়ে দরজায় উপস্থিত ২০২২। বিদায়ী বছরে স্বাস্থ্য খাতের সব মনোযোগ আগের বছরের মতোই করোনাতেই নিবদ্ধ ছিল।

গত বছর করোনার ২য় ঢেউ বাংলাদেশকে বিপর্যস্ত করেছে বেশি। এই এক বছরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসক, পুলিশ, রাজনীতিবিদ, এমপি-মন্ত্রীসহ না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ। আর করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্তের সংখ্যাও ছাড়িয়েছে এক মিলিয়ন।

স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, করোনা মহামারি মোকাবিলায় ২০২১ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের সব নাগরিকের জন্য টিকা নিশ্চিত করা। তবে এখন পর্যন্ত দেশের অর্ধেকের মতো মানুষ করোনা টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন। এবার সরকারের লক্ষ্য, ২০২২ সালের জুনের মধ্যে সবাইকে ২ ডোজ টিকা দেওয়া এবং বছরের শেষ নাগাদ সবাইকে বুস্টার ডোজ দেওয়া।

জানা গেছে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি করোনায় দেশে ৭ হাজার ৫৭৬ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। আর এ বছর ১ জানুয়ারি (শনিবার) তারা জানায় করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা এখন ২৮ হাজার ৭৬। তার মানে এক বছরে ২০ হাজার ৫শ জন মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত করোনা বিষয়ক বুলেটিন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিদায়ী বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছিল ২১ হাজার ৬২৯ জন। তখন সংক্রমণের হার ছিল ৫ শতাংশ। তাদের মধ্যে ওই মাসেই ভাইরাসটিতে মৃত্যু হয় ৫৬৮ জনের। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে করোনা সংক্রমণ কমে আসতে শুরু করে। ওই মাসটিতে করোনা শনাক্ত হয় ১১ হাজার ৭৭ জনের। ফেব্রুয়ারিতে দেশে সংক্রমণের হার এসে দাঁড়ায় ৩ শতাংশে। এক মাসে মৃত্যু হয় ২৮১ জনের।

এরপর মার্চ মাসে এসে এক লাফে তিন শতাংশ থেকে সংক্রমণের হার ১০ শতাংশে উঠে যায়। ওই মাসটিতে দেশে করোনা শনাক্ত হয় ৬৫ হাজার ৭৯ জনের। মৃত্যু হয় ৬৩৮ জনের। ধরে নেওয়া হয় করোনার ২য় ঢেউ শুরু হয়েছে।

এপ্রিলে এসে দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হতে থাকে। কয়েকদিনের ব্যবধানে সংক্রমণের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। মাসটিতে করোনা শনাক্ত হয় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮৩৭ জনের। শনাক্তের হার ১৮ শতাংশে পৌঁছায়। কেবল এপ্রিল মাসেই করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২ হাজার ৪০৪ জন।

মে মাসে আবারও সংক্রমণ কিছুটা কমতে থাকে। মাসটিতে দেশে করোনা শনাক্ত হয় ৪১ হাজার ৪০৮ জনের। ওই মাসে শনাক্তের হার ৯ শতাংশে নেমে আসে। ওই মাসে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১ হাজার ১৬৯ জন। 

জুন মাসে সংক্রমণের হার ৯ শতাংশে আসলেও পরবর্তী মাসেই আবার বেড়ে গিয়ে শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ শতাংশে। মাসটিতে ১ লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়। মারা যান আরও ১ হাজার ৮৮৪ জন।

জুলাই মাসে দেশে শনাক্তের হার রেকর্ড অবস্থানে পৌঁছে যায়। ১৭ শতাংশ থেকে শনাক্তের হার গিয়ে পৌঁছায় ৩০ শতাংশে। মাসটিতে ৩ লাখ ৩৬ হাজার ২২৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়। না ফেরার দেশে পাড়ি জমান রেকর্ড ৬ হাজার ১৮২ জন। 

মাসব্যাপী ধ্বংসলীলার পর আগস্ট মাসে দেশে করোনা সংক্রমণ আবারও কিছুটা কমে আসে। তবে তুলনামূলক প্রাণঘাতীই থাকে করোনা। মাসটিতে শনাক্ত হয় ২ লাখ ৫১ হাজার ১৩৪ জনের। শনাক্তের হার দাঁড়ায় ২১ শতাংশ। মারা যান ৫ হাজার ৫১০ জন।

সেপ্টেম্বরে সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। পুরো মাসজুড়ে শনাক্ত হয় ৫৫ হাজার। সংক্রমণের হার ৭ শতাংশে নেমে আসে। মৃত্যু হয় ১ হাজার ৩১৫ জনের। 

এরপর অক্টোবর মাসেই দেশে শনাক্তের হার ২ শতাংশে নেমে আসে। মাসজুড়ে করোনা শনাক্ত হয় ১৩ হাজার ৬২৮ জনের দেহে। মৃত্যু হয় ৪৫৮ জনের।

নভেম্বর মাসে সংক্রমণের হার কমে এক শতাংশে চলে আসে। মাসটিতে করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত হয় ৬ হাজার ৭৪৫ জন মানুষ। মারা যান ১১৩ জন।

ডিসেম্বরে এসে করোনা আরও দুর্বল হওয়ার কথা থাকলেও ওমিক্রনের প্রভাবে সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছে। শনাক্ত সংখ্যা আগের মাসের চেয়ে ৩ হাজার বেড়ে ৯ হাজারের ঘরে পড়ে। তবে মারা যাওয়ার সংখ্যাটা কমই আছে। ডিসেম্বরে মারা যান ৯১ জন।

টিকা কার্যক্রম

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ টিকা এবং কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় ৬ কোটি ৮০ লাখ টিকা পাওয়ার আশা নিয়ে বছরের শুরুতে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করে সরকার। 

গত বছরের ২৬ জানুয়ারি থেকে টিকার জন্য ‘সুরক্ষা’ অ্যাপের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়। কিন্তু হঠাৎ করে সেরাম থেকে টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা আসায় প্রায় ১ মাস এই কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়। ২০২১ সালের এপ্রিলে ভারত সরকার টিকা রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে মাত্র ৭০ লাখ ডোজ দেওয়ার পর টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সেরাম।

এরপর সেরাম থেকে টিকা না পেয়ে সরকার বাধ্য হয়ে অন্যান্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ শুরু করে। অবশেষে চীন থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ ডোজ সিনোফার্ম টিকা পাওয়ার পর জুনে পুনরায় টিকা দেওয়া শুরু হয়। 

এরপর আর থামতে হয়নি। এখন পর্যন্ত টানা টিকাদান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। দেশে টিকা সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে টিকাদান কর্মসূচিতেও গতি বৃদ্ধি করে স্বাস্থ্য বিভাগ।

সবমিলিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে মোট ৭ কোটি ৩৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬২৩ জনকে এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৫ কোটি ১৮ লাখ ১ হাজার ৫২ জন।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, করোনায় একটি মৃত্যুও আমরা আশা করি না। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো আছে। আমরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছি। আমাদের সব কাজ চলছে।

তিনি বলেন, তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, করোনার সংক্রমণ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। দেশে করোনার দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন এসেছে। যদি সবাই নিজ থেকে সতর্ক না হই, তাহলে ওমিক্রন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, সংক্রমণ থেকে বাঁচতে আমাদের সবাইকেই টিকা নিতে হবে। টিকা নিলেও মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সামাজিক আচার অনুষ্ঠান সীমিত করতে হবে।

টিআই/এসকেডি