ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবহন ও ময়লা ব্যবস্থাপনা- যেন ‘ওপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’। ধামাচাপা দিয়ে রাখা ‘দুর্গন্ধ’ যখন বেরিয়ে এলো, তার আগেই চাপা দিয়ে একের পর এক প্রাণ কেড়ে নিলো ময়লার গাড়ি। 

নিহতদের একজন নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান (১৭)। গত ২৪ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টায় ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারান তিনি। এতে ঢাকার রাজপথে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তুমুল আকার ধারণ করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বাধ্য হয় নড়েচড়ে বসতে। তাৎক্ষণিক তদন্ত কমিটি গঠন করে, শুরু হয় তদন্ত। তাতে সামনে উঠে আসে ডিএসসিসির অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার নানা চিত্র। 

নাঈম নিহত হওয়ার পরের দিনই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্স এলাকায় প্রাণ হারান আহসান কবির খান। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকের সাবেক কর্মী ছিলেন। এরপর ২ ডিসেম্বর উত্তর সিটি করপোরেশনেরই এক ময়লার গাড়ি যাত্রীবাহী বাসে ধাক্কা দিলে আরজু বেগম নামের (৬৫) এক বৃদ্ধা আহত হন। কয়েকদিন আগে গত ২৩ ডিসেম্বর রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন স্বপন কুমার সরকার (৬২) নামে আরও এক ব্যক্তি।

নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান

এই যখন চিত্র তখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ডিএসসিসির মোট যানবাহন ৫১৩টি হলেও নিবন্ধিত চালক মাত্র ১৪৭ জন। এছাড়া ২০০ গাড়ি চলে মাস্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্ত চালক দিয়ে। তাদের অধিকাংশই ক্লিনার। এসব চালকের নেই প্রশিক্ষণ বা লাইসেন্স। ১৬৬টি গাড়ি কীভাবে চলে তার সঠিক তথ্য নেই ডিএসসিসির কাছে। বাকি গাড়িগুলো চলে অদক্ষ ও অনিবন্ধিত চালক দিয়ে। ফলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।

তদন্তে ডিএসসিসির অব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো নজরে এসেছে। গত ২৫ নভেম্বর অবৈধভাবেই গাড়ি বরাদ্দ গ্রহণ করে তা চালানোয় পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো. হারুন মিয়াকে কর্মচ্যুত করে ডিএসসিসি। একইসঙ্গে গাড়ি চালানোর কাজে সহযোগিতা করায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো. আব্দুর রাজ্জাককে কর্মচ্যুত করে। 

এরপর গত ৩০ নভেম্বর বরাদ্দকৃত গাড়ি নিজে না চালিয়ে অন্যকে দিয়ে চালানোর অভিযোগে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবহন বিভাগের গাড়িচালক (ভারী) মো. সাইফুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি দায়ের করা হয় বিভাগীয় মামলা। 

শুধু সাময়িক বরখাস্তেই থেমে থাকেনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটি। শুরু হয় আরও বিস্তর তদন্ত। এতে দেখা যায় ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগটি অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতিতে ঠাসা।

দক্ষিণ সিটির পরিবহন বিভাগ সূত্র বলছে, যে গাড়ির চাপায় নাঈম হাসান নিহত হয়েছেন সেটি ভারী যান। সংস্থাটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে ব্যবহারের জন্য এমন ৩১৭টি ভারী যান আছে। কিন্তু চালক আছেন মাত্র ৮৬ জন। চলমান নিয়ম অনুযায়ী পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মধ্যে যাদের লাইসেন্স আছে, তারা গাড়িগুলো চালাচ্ছেন। ফলে এমন দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে।

তদন্ত কমিটি জানতে পারে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় হারুন মিয়া নামের যে চালককে কর্মচ্যুত করা হয় তিনি ডিএসসিসির নিয়োগপত্র গাড়ি চালক নন। ১৮ মাস ধরে ময়লাবাহী গাড়ি চালাতেন তিনি। এজন্য তাকে পরিবহন বিভাগকে খুশি করে চলতে হতো।

জানা গেছে, তদন্ত কমিটির কাছে ডিএসসিসির পরিবহন শাখার মহাব্যবস্থাপক ময়লার গাড়ির বিপরীতে চালকদের যে তালিকা দিয়েছেন তাতে হারুনের নামে কোনো গাড়ি বরাদ্দ ছিল না। তবে তেলের টোকেন সংগ্রহ, পাম্প থেকে তেল নেওয়া, গাড়ি মেরামত সব স্থানেই হারুনের স্বাক্ষর রয়েছে। এদিকে পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক গত এপ্রিল মাসে ৮৮টি ময়লাবাহী ভারী গাড়ি পরিচালনার জন্য দায়িত্ব বণ্টন করেছেন। এরমধ্যে ভারী গাড়ি চালক ছিলেন ২২ জন। পাশাপাশি হালকা গাড়ি চালক ছিলেন ২২ জন আর পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মশক নিধন কর্মী, ওষুধ সরবরাহকারী এবং বহিরাগত মিলে মোট আরও ৪৪ জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যা আইন বহির্ভূতভাবে দেওয়া হয়েছে। নানান অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে এমনটা সম্ভব হয়েছে। 

নাঈমের মৃত্যুর পর ডিএসসিসি যে তদন্ত কমিটি গঠন করে তার আহ্বায়ক করা হয় প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর সিতওয়াত নাঈমকে। তিন সদস্যের ওই কমিটির সদস্য করা হয় মহা-ব্যবস্থাপক (পরিবহন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আনিছুর রহমানকে। 

কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কমিটির কার্য পরিধির মধ্যে ছিল এই দুর্ঘটনা কীভাবে সংগঠিত হলো তা সবিস্তারে উত্থাপন ও দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানো যায়, সেজন্য সুপারিশ করা। 

গত ১৫ ডিসেম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রের (এসটিএস) উদ্বোধন শেষে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, চালকের যে পদগুলো খালি আছে সেগুলো পূরণের জন্য আমরা এরই মাঝে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। নিয়মিত গাড়ি চালক ও ভারী গাড়ি চালক নিয়োগের ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে একটি বিষয়, আমাদের জনবলের স্বল্পতা রয়েছে। এই স্বল্পতা কাটিয়ে ওঠাটাই আমাদের জন্য বেশি প্রতিকূলতা।

একই অনুষ্ঠানে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, এ ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি। যাদের অনিয়ম ছিল তাদের আমরা কর্মচ্যুত করেছি, অপসারণ করেছি। প্রতিবেদনে যেসব অনিয়ম পাওয়া গেছে, সেই প্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের ৯ জন নিয়মিত গাড়ি চালক, যারা ভাড়াটে লোক দিয়ে গাড়ি চালাত। তারা গাড়ি না চালিয়ে দায়িত্ব অবহেলা করেছে। সে বিষয়টা আমাদের তদন্তে উঠে এসেছে এবং তাদেরকে আমরা সাময়িক বরখাস্ত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করেছি।

এদিকে ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের জানিয়েছেন, নিজেদের অনুকূলে বরাদ্দ থাকা গাড়ি বহিরাগত লোকদের দিয়ে চালানোর দায়ে ৯ জন চালককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। 

নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ

জানা গেছে, দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অসদাচরণ ও অদক্ষতার অভিযোগে এসব চালককে বরখাস্ত করা হয়। তবে চালকদের বরখাস্তের বিষয়টি প্রথমে গোপন রাখা হয়েছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সচিব স্বাক্ষরিত সাময়িক বরখাস্তের অফিস আদেশে বলা হয়েছে, এসব চালকের অনুকূলে গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হলেও নিজে না চালিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গাড়িচালক নন, এমন ব্যক্তিকে দিয়ে অবৈধভাবে গাড়ি চালনা করে আসছিলেন তারা। 

জানা গেছে, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ৯ চালকের মধ্যে ৭ জন ময়লাবাহী গাড়ির চালক ছিলেন। বাকি দুজন হালকা গাড়ি চালাতেন। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ময়লাবাহী গাড়িচালকেরা হলেন- বেলায়েত হোসেন, ফরিদ আহমেদ, মো. আবদুল্লাহ, কাউছার আলী, জামাল উদ্দিন-২, কবির হোসেন-২ এবং রবিউল আলম। এছাড়া হালকা গাড়িচালকরা- হলেন নূর জালাল শিকদার ও আজিম উদ্দিন।

ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগ বিষয়ে সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবহন বিভাগ একদম নুয়ে পড়েছিল। আমরা তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি এবং তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী আমরা এরই মাঝে কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। আমরা পর্যালোচনা করেছি এবং যারা যারা দোষী, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। যদিও সাময়িক অসুবিধা হবে, একটু দুর্ভোগ হতে পারে, তারপরও আমরা কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, নিয়মিত গাড়ি চালক ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে আমাদের গাড়ি পরিচালনা করব না। আমাদের সম্পদ, আমাদের গাড়ি কাউকে ধরতে দেব না। এ ব্যাপারে আমরা কঠোর। যারা যারা এই নিয়ম ভঙ্গ করে এগুলো করে আসছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব এবং ভবিষ্যতে যাতে আর এ ধরনের সুযোগ না থাকে, সে জন্য আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি।

এএসএস/এইচকে