৫০ হাজার টাকা চাঁদা না পেয়ে কক্সবাজারে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ
মাত্র আট মাস বয়সী শিশুর হার্টে সমস্যা। চিকিৎসার খরচ জোগাতে সেই শিশুসন্তান আর স্বামীকে নিয়ে কক্সবাজারে যান সাহায্যপ্রার্থী নারী। তারপর গত তিনমাস ধরে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে হাত পেতে চান সহায়তা।
এই অসহায় নারীর কাছেই চাঁদা দাবি করে বসে স্থানীয় আশিকুর রহমান। চাঁদা না পেয়ে তার সংঘবদ্ধ চক্রটি ক্ষুব্ধ হয়। এরপর গত ২২ ডিসেম্বর (বুধবার) লাবনী বিচ এলাকার রাস্তা থেকে ওই নারীকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তুলে নিয়ে যায় তারা।
বিজ্ঞাপন
রাত ৮টার দিকে সৈকত পোস্ট অফিসের পেছনে একটি ঝুপড়ি চায়ের দোকানে নিয়ে যায়। সেখানে দোকানটির পেছনে থাকা কক্ষে আশিকের দুই বন্ধু নারীটিকে ধর্ষণ করে। এরপর তাকে মোটরসাইকেলে তুলে কলাতলী জিয়া গেস্ট ইন হোটেলে নেয় আশিক। সেখানে তাকে ধর্ষণ করে সেও। আর তার স্বামীর কাছে দাবি করে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ। এরপর তাকে হোটেলে আটকে রেখে বের হয়ে যায় আশিক।
কক্সবাজারে নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনার মূলহোতা ও প্রধান আসামি আশিকুল ইসলাম আশিককে মাদারীপুর থেকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এসব কথা জানিয়েছে র্যাব।
র্যাব বলছে, ওই নারী চক্রটির পূর্ব পরিচিত ছিল না। ঘটনার একদিন আগে সৈকতে তাদের পরিচয় হয়। সেসময় ওই নারী শিশু সন্তানের চিকিৎসার জন্য ট্যুরিস্টদের কাছে অর্থ সহযোগিতা চাচ্ছিলেন।
সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) বেলা ১১টায় কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২২ ডিসেম্বর রাতে কক্সবাজারে গণধর্ষণের শিকার হন এক নারী। ওই ঘটনায় ভিকটিমের স্বামী বাদী হয়ে চার জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও দুই/তিন জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। ওই ঘটনায় ট্যুরিস্ট পুলিশ, জেলা পুলিশের পাশাপাশি ছায়া তদন্ত করছিল র্যাব।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগী ওই নারী স্বামী-সন্তানসহ কক্সবাজারের একটি হোটেলে অবস্থান করছিলেন। তাদের সঙ্গে আট মাস বয়সের একটি শিশু সন্তান রয়েছে। শিশুটির জন্মগতভাবে হার্টে ছিদ্র থাকায় তার চিকিৎসায় ১০ লাখ টাকা প্রয়োজন। শিশুটির চিকিৎসার অর্থ সংকুলানের আশায় স্বামীসহ কক্সবাজারে অবস্থান করছিল পরিবারটি। তারা বিত্তবান পর্যটকদের কাছে অর্থ সাহায্য চাইত। এরমধ্যেই ওই নারী অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হলেন।
অপহরণের ঘটনায় ভিকটিমের স্বামী র্যাব-১৫ এর কাছে উদ্ধারে সহায়তা চায়। পরে র্যাব ভিকটিমের স্বামীকে নিয়ে উদ্ধারে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায় এবং একপর্যায়ে ভিকটিম উদ্ধার হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে জিম্মি করতে সহযোগিতার অভিযোগে জিয়া গেস্ট ইন হোটেলের ম্যানেজার রিয়াজ উদ্দিন ছোটনকে গ্রেফতার করে র্যাব।
ইতোমধ্যে ধর্ষণের ঘটনাটি সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার হওয়ায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। র্যাব হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে আসামিদের শনাক্ত ও জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৮ ও ১৫ এর অভিযানে গত রাতে (রোববার) মাদারীপুরের মোস্তাফাপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত মামলার প্রধান আসামি আশিকুল ইসলামকে (২৯) গ্রেফতার করা হয়।
কমান্ডার মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হওয়া আশিক র্যাবের কাছে ধর্ষণের বিষয়টি স্বীকার করেছে।
তিনি জানান, আশিক কক্সবাজারে পর্যটন এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের মূলহোতা। এ চক্রের সদস্য সংখ্যা ৩০-৩৫ জন। আশিক ২০১২ সাল থেকে কক্সবাজার পর্যটন এলাকায় বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। সে প্রথম ২০১৪ সালে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয় বলে জানা যায়।
সে ও তার সিন্ডিকেট পর্যটন এলাকা কক্সবাজারে চুরি, ছিনতাই, অপহরণ, জিম্মি, চাঁদাবাজি, জবরদখল, ডাকাতি ও মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। সে পর্যটন এলাকায় বিভিন্ন হোটেলে ম্যানেজারের সঙ্গে যোগসাজশে ট্যুরিস্টদের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করত।
চাঁদা না পেয়ে অপহরণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হওয়া আশিক জানায়, সে ও তার সহযোগীরা প্রথমে ভিকটিম ও তার পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। ভিকটিম ও তার পরিবার চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর লাবনী বিচ এলাকার রাস্তা থেকে ভিকটিমকে সিএনজিতে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
আশিকুল ইসলাম ভিকটিমকে ধর্ষণ এবং জিয়া গেস্ট ইন হোটেলে আটকে রেখে ভিকটিমের স্বামীর কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এরপর ভিকটিমকে হোটেলে আটকে রেখে আশিক হোটেল থেকে বের হয়ে যায়।
বিষয়টি ব্যাপকভাবে স্থানীয় পর্যায়ে ও বিভিন্ন মিডিয়াতে জানাজানি হলে আশিক আত্মগোপনে চলে যায়। পরে বেশভূষা পরিবর্তন করে ঘটনার দুদিন পর কক্সবাজার থেকে একটি এসি বাস যোগে ঢাকায় আসে। পরে ঢাকা থেকে পটুয়াখালী যাওয়ার পথে সে মাদারীপুরের মোস্তাফাপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়।
হোটেল জবরদখলে বেশি ভাড়া আদায়, ট্যুরিস্টদের হয়রানি
গ্রেফতার আশিক পর্যটন এলাকা কক্সবাজারে আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন রকম জবরদখল ও অবৈধ কর্মকান্ডে জড়িত রয়েছে। সে পর্যটন এলাকার সুগন্ধা এলাকায় ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট জোরপূর্বক কম টাকা দিয়ে ভাড়া নিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে দ্বিগুণ ও তিনগুণ ভাড়া আদায় করে মূল মালিকদের বঞ্চিত করে। গ্রেফতার আশিক বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অবৈধ দখল করে এবং চাঁদা দাবি করে। তার চক্রের সদস্যরা রাতে বিচে আসা ট্যুরিস্টদের হেনস্তা, মোবাইল ছিনতাই, ফাঁদে ফেলা ও নিয়মিত ইভটিজিং করত। পাশাপাশি হোটেল-মোটেল জোনে বিভিন্ন ট্যুরিস্টদের সুযোগ বুঝে ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করত।
২০১৮ থেকে ২০২১ আড়াই বছর জেলেই ছিল আশিক
তার নামে ইতোমধ্যে কক্সবাজার সদর থানায় অস্ত্র, মাদক, নারী নির্যাতন ও চাঁদাবাজিসহ ১২টি মামলা চলমান রয়েছে। আগে সে পাঁচবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সে প্রায় আড়াই বছর কারাভোগ করেছে। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। ওই ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে বলে জানায় র্যাব।
জেইউ/এসএসএইচ/জেএস