রাজধানীতে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি সদস্য মনোরঞ্জন হাজংয়ের গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় ‘মামলা নিচ্ছে না পুলিশ’— এমন অভিযোগ উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত ঘটনার ১৪ দিন পর বৃহস্পতিবার বিকেলে ভুক্তভোগীর মেয়ে সার্জেন্ট মহুয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে মামলাটি নিয়েছে বনানী থানা পুলিশ।

তবে, অভিযোগকারী দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করে মামলা করতে চাইলেও তেমনটা হয়নি। যে মামলাটি নেওয়া হয়েছে তাতে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ৩ ব্যক্তিকে। আহত মনোরঞ্জনের পরিবার বলছে, ‘অজ্ঞাত’ কোনো এক চাপে আসামিদের ‘অজ্ঞাত’ নাম দেওয়া হয়েছে। মামলা দায়ের নিয়ে গণমাধ্যমে সার্জেন্ট মহুয়ার কথা বলতেও ‘মানা’ রয়েছে উপর মহল থেকে।  

মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভুক্তভোগীর মেয়ে সার্জেন্ট মহুয়া হাজংয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলাটি দায়ের হয়েছে।’ মামলায় আসামিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে কি না— এ প্রশ্ন এড়িয়ে তিনি বলেন, ‘মামলা হয়েছে, আপাতত এটুকুই তথ্য।’

বনানী থানা সূত্রে জানা যায়, সড়ক নিরাপত্তা আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। মামলার নম্বর ২৫। আসামিরা অজ্ঞাতনামা। এ বিষয়ে বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নূরে আজম মিয়া বলেন, ‘অজ্ঞাতনামা আসামি করে নিরাপদ সড়ক আইনে আজ মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।’

তবে মামলাটি আদৌ দায়ের হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে মনোরঞ্জনের পরিবার। এ নিয়ে ভুক্তভোগীর ছেলে মৃত্যুঞ্জয় হাজং ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে শুনছি অজ্ঞাতনামা আসামি উল্লেখ করে বনানী থানা একটি মামলা নিয়েছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে আমাদের এখনো  কিছু জানানো হয়নি।’ 

তিনি বলেন, ‘অজ্ঞাতনামা আসামি রেখে মামলা করলে কী লাভ হবে? আসামিদের নাম ঠিকানা, মূল অভিযুক্তের নাম এবং তার বাবা যে একজন বিচারপতি— এসব বিষয় উল্লেখ করে আমার দিদি (সার্জেন্ট মহুয়া) গত ১৩ ডিসেম্বর বনানী থানায় অভিযোগ করেন। যদি অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়, তাহলে পুলিশ আমাদের এজাহার না নিয়ে তাদের তৈরিটিই নিয়েছে। 

‘আমাদের দাবি, আমরা যাদের অভিযুক্ত করে মামলা করতে চেয়েছিলাম, তাদের এ মামলায় আসামি করতে হবে। আমার বাবার সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে এর সুষ্ঠু বিচার চাই’— বলেন মৃত্যুঞ্জয়। 

এদিকে, মামলা না করতে এবং গণমাধ্যমে কোনো কথা না বলতে ভুক্তভোগীর পরিবারকে ‘চাপ দেওয়া হচ্ছে’ বলেও মনোরঞ্জনের পরিবারের পক্ষ থেকে ঢাকা পোস্টকে জানানো হয়েছে। 

গত ২ ডিসেম্বর বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় মনোরঞ্জনের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয় একটি প্রাইভেটকার। আহত হওয়ার পর থেকে তিনি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। বর্তমানে তিনি বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতে রয়েছেন।

ভুক্তভোগী সাবেক বিজিবি সদস্যের মেয়ে মহুয়া হাজং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে সার্জেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। গত ১০ ডিসেম্বর তিনি বনানী থানায় অভিযুক্তদের নাম-পরিচয় উল্লেখপূর্বক মামলা করতে যান।  কিন্তু মামলা ‘নেয়নি’ থানা পুলিশ। এরপরও তিনি একাধিকবার মামলা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু মামলা নেওয়া হয়নি।

এর আগে মনোরঞ্জনের ভাইয়ের ছেলে মনিরাজ হাজং বৃহস্পতিবার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অভিযুক্তরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে শুরুতে কোনো মামলা নেয়নি পুলিশ। পরে মহুয়ার এজাহার বাদ দিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে নতুন এজাহার লিখতে বলা হয়। অজ্ঞাতদের আসামি করে আজ মামলা দায়ের হয়েছে বলে শুনেছি।’   

গণমাধ্যমে কথা না বলতে মহুয়াকে চাপ দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আসামিদের নাম উল্লেখপূর্বক মামলা যাতে না করা হয় সেজন্য দিদি (মহুয়া) এবং আমাদের ওপর শুরু থেকেই চাপ ছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হচ্ছে। এতে মহুয়ার ওপর ডিপার্টমেন্ট থেকে নতুন করে চাপ আসছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চাপ দিচ্ছেন— যেন বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে তিনি কোনো কথা না বলেন।’ 

মহুয়াকে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ‘তোমার জন্য পুলিশের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে, তুমি মিডিয়াতে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারবে না’।

তার সঙ্গে যেন গণমাধ্যমকর্মীরা বারডেম হাসপাতালে গিয়ে কথা বলতে না পারেন, সেজন্য আলাদা নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা হয়েছে চিকিৎসাধীন মনোরঞ্জনের কেবিনের সামনে। ‘এ কারণে মহুয়া অনেক ভয় পেয়ে গেছেন। অপরিচিত কারো সঙ্গে তিনি কথা বলছেন না। গণমাধ্যমে সত্য কথা বললে যদি বাবাকে আইসিইউ থেকে বের করে দেওয়া হয়, সেই ভয়ে মহুয়া কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না’— বলেন মনিরাজ।

বারডেম হাসপাতালে মনোরঞ্জন হাজংয়ের ছেলে মৃত্যুঞ্জয় হাজংয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে দেখা যায়, বাবার শারীরিক অবস্থা নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত। বিভিন্ন মহলের ‘চাপে’ তার পরিবার এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত যে, কারো সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে না । 

বৃহস্পতিবার দুপুরে মৃত্যুঞ্জয় হাজং বলেন, ‘দিদির (মহুয়া) উপর মহল থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তাই সে ভয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে পারছে না। টাকা পয়সা নিয়ে আপস করে ফেলার জন্য আমাদের বার বার চাপ দেওয়া হচ্ছে। আমরা প্রথমে যাকে মূল অভিযুক্ত দেখিয়ে মামলাটি করতে চেয়েছিলাম, তিনি একজন বিচারপতির ছেলে। পুলিশ আমাদের এজাহার পরিবর্তন করে অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে একটি নতুন এজাহার লিখতে বাধ্য করেছে।’

ঘটনার দিনের একাধিক ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশের একজন সার্জেন্টকে অভিযুক্তদের দেখিয়ে দিচ্ছেন। আর সেই সার্জেন্টকে অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে।

মনোরঞ্জন হাজংয়ের দুর্ঘটনায় তার পরিবারের সদস্যদের দায়ের করতে চাওয়া মামলা নেওয়া হবে কি না, বৃহস্পতিবার দুপুরেও সে প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না কারো।  তখন ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. আসাদুজ্জামানের কাছে জানতে চায় ঢাকা পোস্ট।  তখন তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া চলমান।’
 
কেমন আছেন মনোরঞ্জন

ছেলে মৃত্যুঞ্জয় জানান, তার বাবার শারীরিক অবস্থা ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যাচ্ছে। গত রাতে তিনি হার্ট অ্যাটাক করেছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার বাবার ফুসফুসে পানি জমে গেছে। ঘটনার পরে ৩ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রোপচার করে মনোরঞ্জনের ডান পায়ের গোড়ালি নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। 

এই অস্ত্রোপচারের পর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ৮ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফা অস্ত্রোপচার করে তার ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। কিন্তু সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ডান পায়ের উরু থেকে সম্পূর্ণ পা কেটে ফেলার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। পরে সেটাই করা হয়

এরপরও মনোরঞ্জনের শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটলে গত ১৩ ডিসেম্বর তাকে বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। 

২০০৪ সালে মনোরঞ্জন হাজং বিজিবি থেকে অবসরে যান। এরপর থেকে তিনি বনানীর একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সেবা-দানকারী প্রতিষ্ঠানে সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত আছেন। তার বাড়ি নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলায়।

এমএসি/আরএইচ/জেএস