বদলে যাবে পুরান ঢাকা
জরাজীর্ণ ভবন, ঘিঞ্জি পরিবেশ, অপরিকল্পিত ও ফুটপাতহীন সংকীর্ণ রাস্তা, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত রাজধানীর পুরান ঢাকা। এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য চিন্তা করছে সরকার। এ লক্ষ্যে নেওয়া হচ্ছে নতুন প্রকল্প। এর মাধ্যমে পুরান ঢাকাকে সাজানো হবে নতুনভাবে।
জানা গেছে, পুরান ঢাকায় অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত অনেক ভবনেরই বয়স ১০০ বছরের বেশি। এর মধ্যে বেশির ভাগই সময়োপযোগী নয়। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনেক সংকীর্ণ। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন প্রকল্প নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। নগর পুনঃউন্নয়ন (আরবান রিডেভেলপমেন্ট) শীর্ষক এ প্রকল্পের সারসংক্ষেপ এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ইসলামবাগের প্রায় ১৪ দশমিক ৯৪ একর, চকবাজারের প্রায় দেড় একর, মৌলভীবাজারের শূন্য দশমিক ৬০ একর, বংশালের প্রায় ১২ দশমিক ৭১ একর, হাজারীবাগের ১১১ দশমিক ০৩ একর, কামরাঙ্গীরচরের প্রায় ৩৩ একর এবং লালবাগের প্রায় ৩২ দশমিক ৭২ একর জায়গাকে পুনঃউন্নয়নের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে
প্রকল্পের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরীর দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আটটি থানা নিয়ে পুরাতন ঢাকা অবস্থিত। আদি এ জনপদের একদিকে যেমন রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং হেরিটেজ সাইটের গৌরব; অন্যদিকে সময়ের বিবর্তনে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে পুরাতন ঢাকা হয়েছে জরাজীর্ণ, সংকীর্ণ রাস্তা ও অপর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধাদির সমস্যায় জর্জরিত। পুরাতন ঢাকার স্বকীয়তা বজায় রেখে পরিকল্পিত নগরায়নের মাধ্যমে এসব নাগরিক সমস্যা থেকে উত্তরণের একটি পথ হতে পারে নগর পুনঃউন্নয়ন বা আরবান রিডেভেলপমেন্ট।
প্রকল্প সম্পর্কে বলা হয়, নগর পুনঃউন্নয়ন বা আরবান রিডেভেলপমেন্ট হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অপরিকল্পিত, ঘনবসতিপূর্ণ, অপ্রতুল নাগরিক সুবিধাদি সম্পন্ন কোনো এলাকাকে বাসিন্দাদের চাহিদা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাদের মতামত সন্নিবেশিত করে পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধাদি সম্পন্ন একটি পরিকল্পিত এলাকা হিসাবে গড়ে তোলা যায়। এ প্রক্রিয়ায় ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। যেমন- নগর পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প এলাকায় পুরান, জরাজীর্ণ ভবন অপসারণ করে নতুন ভবন নির্মাণ করা। এর মাধ্যমে ভূমির যথাযথ উন্নয়নে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা তৈরি হয়। যেখানে পার্ক, খেলার মাঠ, নাগরিক সুবিধাদি, প্রশস্ত রাস্তা প্রভৃতির সংস্থান করা যায়। তবে প্রকল্প এলাকায় হেরিটেজ হিসেবে বা অন্যান্য দৃষ্টিকোণ থেকে বেশকিছু স্থাপনা সংরক্ষণও করা যেতে পারে।
পুরান ঢাকাকে পুনর্নির্মাণ করার মাধ্যমে এমনভাবে সাজানো হবে, যা সত্যিকার অর্থেই হবে দেখার মতো একটি শহর
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম
নগর পুনঃউন্নয়ন বা আরবান রিডেভেলপমেন্টের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো- এ প্রক্রিয়ায় কোনো ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয় না। ফলে একদিকে যেমন প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্থ সাশ্রয় হয়, অন্যদিকে এ প্রকল্পের মূল সুবিধাভোগী হন প্রকল্প এলাকায় বসবাসকারী জনগণ। এছাড়া, এ প্রক্রিয়ায় মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয় বলে আবাসনের পাশাপাশি প্রকল্পভুক্ত জনগণের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়।
প্রাথমিকভাবে ৭ স্থানে বাস্তবায়িত হবে এ প্রকল্প
প্রাথমিকভাবে পুরান ঢাকার সাতটি স্থানে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এ লক্ষ্যে প্রকল্পের সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ বিষয়ক রাজউকের পাঁচ সদস্যের কমিটি একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রকল্পের সারসংক্ষেপে যুক্ত করা হয়েছে।
কমিটির সদস্যরা সরেজমিন পরিদর্শনে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত, স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) (২০১৬-২০৩৫) প্রকল্পের সার্ভে ডাটাবেজ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে পুরান ঢাকার সাতটি স্থানকে পুনঃউন্নয়নের জন্য চিহ্নিত করেছেন।
কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসলামবাগের প্রায় ১৪ দশমিক ৯৪ একর, চকবাজারের প্রায় দেড় একর, মৌলভিবাজারের শূন্য দশমিক ৬০ একর, বংশালের প্রায় ১২ দশমিক ৭১ একর, হাজারীবাগের ১১১ দশমিক ০৩ একর, কামরাঙ্গীরচরের প্রায় ৩৩ একর এবং লালবাগের প্রায় ৩২ দশমিক ৭২ একর জায়গাকে পুনঃউন্নয়নের জন্য চিহ্নিত করা হয়।
স্থান নির্ধারণের বিষয়ে ১০ প্রস্তাব
রাজউকের পাঁচ সদস্যের কমিটি প্রকল্প গ্রহণের সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণের বিষয়ে ১০টি সুপারিশ করেছে। যা প্রকল্পের সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো—
১. সম্ভাব্য সাতটি প্রকল্প এলাকার সীমানা চূড়ান্তের জন্য এবং প্রকল্প গ্রহণের জন্য বিস্তারিতভাবে ভৌত ও আর্থ-সামাজিক জরিপ, পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা, পরিবহনগত প্রভাব সমীক্ষা ও সামাজিক প্রভাব সমীক্ষার সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে হবে। এছাড়া বসবাসকারী, জীবিকা নির্বাহকারী জনসাধারণসহ সকল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা আয়োজন করে সে মোতাবেক প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করতে হবে।
২. নগর পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ বিষয়ক একটি খসড়া নীতিমালা রাজউক থেকে প্রণয়ন করা হয়েছে, যা চূড়ান্ত করা প্রয়োজন।
৩. প্রকল্প এলাকাগুলোতে ঐতিহ্যগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সংরক্ষণ করতে হবে এবং স্থানীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে নগর পুনঃউন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৪. প্রকল্প এলাকাভুক্ত সাধারণ জনগণ যেন মূল সুবিধাভোগী হন তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, নাগরিক সুবিধাদি এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণের চাহিদা অনুযায়ী এবং নগর পরিকল্পনার যথাযথ মানদণ্ডের ভিত্তিতে সংস্থান করতে হবে।
৫. ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোসহ সংশ্লিষ্ট সব সরকারি দপ্তর, সংস্থা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
৬. প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান প্রধান সড়কের সঙ্গে প্রকল্প এলাকার সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. সমগ্র পুরাতন ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কগুলো চিহ্নিত করে ট্রাফিক প্রভাব সমীক্ষা সম্পাদন করে বিদ্যমান সড়ক সম্প্রসারণ, নতুন সড়ক নির্মাণ ও ট্রাফিক চাহিদা ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
৮. নাজিমউদ্দীন রোড ও বকশিবাজার-চকবাজার রোড পুরাতন ঢাকার অন্যতম দুটি প্রবেশদ্বার। রাস্তা দুটিকে জরুরিভিত্তিতে প্রশস্ত করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
৯. প্রকল্প এলাকায় যেসব ভবন অপেক্ষাকৃত নতুন, নির্মিত ও কাঠামোগতভাবে ঝুঁকিমুক্ত, সেসব ভবন যথাযথভাবে যাচাই সাপেক্ষে প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
১০. প্রকল্প চলাকালীন প্রকল্পভুক্ত জনগণের অন্তর্বর্তীকালীন আবাসন সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রকল্প এলাকার কাছে সুবিধাজনক স্থান চিহ্নিত করে অন্তর্বর্তীকালীন আবাসন ব্যবস্থা প্রকল্পের আওতায়ই নিশ্চিত করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) প্রকৌশলী সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই প্রকল্প পরিকল্পনার পর্যায়ে রয়েছে, এখনও বাস্তবায়নে আসেনি। তবে বাস্তবায়ন করতে কাজ করা হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ প্রকল্পের সারসংক্ষেপ পাঠিয়ে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে নির্দেশনা আসলে পরবর্তী কার্যক্রম হাতে নেওয়া হবে
প্রকল্প পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম
বাস্তবায়নে প্রয়োজন সর্বনিম্ন ৫ বছর
রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সর্বনিম্ন পাঁচ বছর সময় লাগবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ প্রকল্পের সারসংক্ষেপ পাঠিয়ে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে নির্দেশনা আসলে পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়া হবে। নির্দেশনার আলোকে আমরা ফিজিবিলিটি স্টাডি বা সম্ভাব্যতা যাচাই করব। চলতি বছরই এ কার্যক্রম শুরু করা যাবে বলে আশা করছি।’
বিদেশি অর্থায়ন আর কিছু সরকারি তহবিলের (জিওবি ফান্ড) টাকা দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে
প্রকল্প পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম
বিদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে প্রকল্প, থাকবে সরকারি তহবিলও
প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বিদেশি অর্থায়ন আর কিছু সরকারি তহবিলের (জিওবি ফান্ড) টাকা দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একটি বিদেশি অর্থায়নের জন্য যোগাযোগ করেছি। সেখান থেকে সাড়াও পাচ্ছি। তবে এখনও চূড়ান্ত হয়নি।’
পূর্ব-পশ্চিমে সূত্রাপুর মিল ব্যারাক থেকে হাজারীবাগ ট্যানারি মোড় পর্যন্ত এবং দক্ষিণে ঢাকা সদরঘাট থেকে নবাবপুর পর্যন্ত বিস্তৃত পুরান ঢাকা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পুরান ঢাকা একসময় অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, সুন্দর ও ছিমছাম একটি শহর ছিল। কিন্তু মুঘল শাসকদের পতনের পর পুরান ঢাকার ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে আসে। ব্রিটিশ শাসকরা কিছুটা দেখভাল করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রী হারিয়েছে পুরান ঢাকা। তবে সরকারের এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে আবারও শ্রী ফিরবে ঐতিহ্যবাহী এ নগরীর।
সত্যিকার অর্থে দেখার মতো একটা শহর হবে
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পুরান ঢাকাকে পুনর্নির্মাণ করার মাধ্যমে এমনভাবে সাজানো হবে, যা সত্যিকার অর্থেই হবে দেখার মতো একটি শহর।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্প নিয়ে আমাদের আর্কিটেকচাররা কাজ করছেন। এটা অনেক বড় কাজ। হয়তো আগামী দুই বছরের মধ্যে মূল কাজ আরম্ভ করতে পারি। তবে পুরো পুরান ঢাকা পুনর্নির্মাণ করতে ১০ থেকে ২০ বছর সময় লাগবে।’
জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার পুনর্নির্মাণ নিয়ে রাজউক কাজ করছে।’
এসএইচআর/এমএআর/