থাকতে চান না বাসিন্দারা, অনীহা দূর করতে পেশাভিত্তিক গুচ্ছগ্রাম
সবার জন্য বাসস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এ প্রকল্পের আওতায় কোটি-কোটি টাকায় নির্মিত হয় ২৫০টির বেশি গুচ্ছগ্রাম। কিন্তু এসব গ্রামে থাকতে চান না বাসিন্দারা। এজন্য অপরিকল্পিত গুচ্ছগ্রাম নির্মাণকে দায়ী করেছেন তারা। এ অবস্থায় পরিকল্পিতভাবে পেশাভিত্তিক গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে ভূমি মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়েছে।
গত ২৯ নভেম্বর সচিবালয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী পেশাভিত্তিক গুচ্ছগ্রাম নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের প্রবর্তন করেন। ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী (বর্তমান লক্ষ্মীপুর) জেলার রামগতি থানা পরিদর্শনকালে নদীভাঙা, দুস্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে খাসজমিতে পুনর্বাসন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন তিনি। সেই সময় বৃহত্তর নোয়াখালী জেলায় চারটি গুচ্ছগ্রামে প্রায় দেড় হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়।
এরপর সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত ১০ বছর মেয়াদে নেওয়া হয় গুচ্ছগ্রাম (পরে তা আদর্শ গ্রাম নামকরণ হয়) প্রকল্প। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ১৯৯৮ সালের জুলাই থেকে আদর্শ গ্রাম প্রকল্প-২ নামে আবার নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। পরে বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নতুন করে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। জাপান সরকারের ঋণ মওকুফ তহবিলের (জেডিসিএফ) অর্থায়নে গুচ্ছগ্রাম (ক্লাইমেট ভিকটিমস রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট) প্রকল্পের প্রথম পর্যায় শুরু হয়।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে দেশের ৭টি বিভাগের ৫৩টি জেলার ১৩১টি উপজেলায় ২৫৩টি গুচ্ছগ্রাম প্রতিষ্ঠা করে। এসব গুচ্ছগ্রামের মাধ্যমে ১০ হাজার ৭০৩টি ভূমিহীন, গৃহহীন, ঠিকানাবিহীন ও নদীভাঙন-কবলিত পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
২০১৫ সালের ১ অক্টোবর গুচ্ছগ্রাম দ্বিতীয় পর্যায় (ক্লাইমেট ভিকটিমস রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট) প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। এ প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে গুচ্ছগ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটি-কোটি টাকায় নির্মিত গুচ্ছগ্রামে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হলেও থাকছেন না পুনর্বাসিত হওয়া অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা। অনিয়ম, অপরিকল্পিতভাবে গড়া, নাগরিক সুবিধা না থাকাকে এর জন্য দায়ী করছেন তারা।
জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাদারীপুর জেলার শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের চরচান্দ্রা মৌজায় হতদরিদ্রদের জন্য একটি গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হয়। নাম দেওয়া হয় ‘চরচান্দ্রা গুচ্ছগ্রাম-২’। ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার এ গুচ্ছগ্রামে বর্তমানে বৈধ বাসিন্দা মাত্র দুই জন। নদীভাঙনে গৃহহীন হওয়া পরিবারের বসবাসের জন্য এ গুচ্ছগ্রাম গড়া হলেও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকায় সেটি ছেড়ে চলে গেছে প্রায় সব পরিবার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুচ্ছগ্রাম করতে হলে সবার আগে মানুষের বসবাসের জন্য ন্যূনতম সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু সেখানে এসবের কিছুই নেই। এজন্যই মূলত থাকতে চান না বাসিন্দারা।
শুধু মাদারীপুর নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা অনেক গুচ্ছগ্রামের চিত্রই এমন। সবমিলিয়ে প্রকল্পটির সুফল পাচ্ছেন না বাসিন্দারা। এজন্য পেশাভিত্তিক গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করে আবারও প্রাণসঞ্চার করার পরিকল্পনা করছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিভিন্ন গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করার ক্ষেত্রে অনিয়মসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। এজন্য গুচ্ছগ্রামে মানুষ থাকতে চায় না। তাই পেশাভিত্তিক গুচ্ছগ্রাম প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা-ভাবনা চলছে।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিভিন্ন পেশাভিত্তিক লোকালয় যেখানে আছে, সেখানে গুচ্ছগ্রাম করলে তারা একদিকে যেমন ভালো আবাসস্থল পাবে, অন্যদিকে সেখানে অর্থনৈতিক সুবিধাও পাবে। এক জায়গায় দুটি সুবিধা পেলে কেউ আর থাকতে অনীহা প্রকাশ করবে না।’
জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পেশাভিত্তিক গুচ্ছগ্রাম নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করছি। এখনও চূড়ান্ত হয়নি। চূড়ান্ত হওয়ার পর বিস্তারিত বলা যাবে।
এসএইচআর/এসএসএইচ