নিরাপদ সড়কের দাবিতে সংশ্লিষ্টদের লাল কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করছেন শিক্ষার্থীরা / ছবি- সংগৃহীত

• গত এক বছরে দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বেড়েছে
• কর মওকুফের পরও মালিকরা ফিটনেস হালনাগাদ করেন না
• ফিটনেসবিহীন বাস-ট্রাকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে : ড. হাদিউজ্জামান
• এসব গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চলছে : বিআরটিএ চেয়ারম্যান

দেশে গত এক বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। দফায় দফায় কর মওকুফের পরও মালিকরা গাড়ির ফিটনেস হালনাগাদ করছেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব গাড়িতে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। বারবার অভিযানে নেমেও কমছে না এ ধরনের গাড়ির সংখ্যা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে অন্তত পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ৭৭টি (৩০ নভেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত)। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এমন গাড়ি ছিল চার লাখ ৮১ হাজার ২৯টি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ২৬ জানুয়ারি এ তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন জাতীয় সংসদে। অর্থাৎ প্রায় এক বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বেড়েছে ৫৯ হাজার ৪৮টি।

কেন ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে— এমন প্রশ্ন খুঁজতে যোগাযোগ করা হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বিআরটিএ’র সঙ্গে। তাদের বক্তব্য, ফিটনেসবিহীন গাড়ির মালিকদের খুদে বার্তা বা এসএমএসের মাধ্যমে ফিটনেস হালনাগাদের জন্য নিয়মিত তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। সংস্থাটির বিভিন্ন সার্কেল কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে জানান, তাদের পক্ষ থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড, ডাম্পিংসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তারপরও মালিকদের একটি বড় অংশ বিষয়টি কর্ণপাত করছেন না।

এ বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এসব গাড়ির মালিকদের অর্থদণ্ড করা হচ্ছে। ১০ বছর বা এর বেশি সময় ধরে ফিটনেসবিহীন গাড়ির তথ্য বিআরটিএ’র ভান্ডার থেকে ধাপে ধাপে মুছে ফেলা হচ্ছে।

বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের জুলাই থেকে তিন দফায় জরিমানা ছাড়াই কর দিয়ে ফিটনেস হালনাগাদের নির্দেশনা জারি করা হয়। এরপরও গাড়ির মালিকদের একটি অংশ নিয়মিতভাবে কর দিচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ অভিযান জোরদারের পাশাপাশি অন্য তদারকি কার্যক্রমও হাতে নিয়েছে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে সাম্প্রতিক আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা গাড়ির ফিটনেসসহ বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা করে দেখেন / ছবি- সংগৃহীত

বিআরটিএ পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) সারোয়ার আলম এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিআরটিএ’র নির্বাহী হাকিমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। পাশাপাশি চলাচলের অনুপযোগী (ফিটনেসবিহীন) গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অর্থদণ্ড করা হচ্ছে, ডাম্পিংয়েও পাঠানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর অন্যান্য কারণের মধ্যে ছিল ৬৬ হাজার ৬৬১টি অনুপযোগী (ফিটনেসবিহীন) গাড়ি। এখনও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ এটি। ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সড়কে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি। ভারী গাড়ির ফিটনেস তুলনামূলকভাবে কম। আমরা আমাদের গবেষণায় দেখতে পেয়েছি, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ভারী গাড়ি বাস ও ট্রাকের সংশ্লিষ্টতা ছিল ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২০ সালে তা বেড়ে হয় ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ফিটনেসহীন এমন গাড়ি বেড়ে যাওয়ায় সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যাও বাড়ছে।

পরীক্ষা ছাড়া কোনো গাড়ির ফিটনেস সনদ নয়

বিআরটিএ প্রধান কার্যালয়ের পরিদর্শন ও পরীক্ষা ছাড়া কোনো গাড়ির ফিটনেস সনদ দেওয়া হচ্ছে কি না, তা তদারকিতে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার গত ২৯ নভেম্বর এ সংক্রান্ত আদেশপত্র জারি করেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, কোনো মোটরযান সরেজমিনে পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বিআরটিএ’র কোনো সার্কেল অফিস থেকে যাতে ফিটনেস সনদ দেওয়া না হয়, বিষয়টি তদারকির জন্য ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির সদস্য খালিদ মাহমুদ, সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.), বিআরটিএ ঢাকা মেট্রো-১, সার্কেলে বদলি হওয়ায় কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। বিআরটিএ পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মো. সিরাজুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে এ কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। বিআরটিএ’র কোনো সার্কেল অফিস থেকে সরেজমিনে না দেখে এবং কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া মোটরযানের ফিটনেস সনদ দেওয়া হচ্ছে কি না— কমিটি তা মনিটরিং করবে। মোটরযানের ফিটনেস সনদ দেওয়ার প্রতিবেদন কমিটিকে নিয়মিতভাবে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করতে হবে।

‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এর ২৫ ধারা অনুযায়ী, বিআরটিএ থেকে মোটরযানের ফিটনেস সনদ নেওয়ার বিধান রয়েছে। তারপরও ১০ বছরের বেশি সময় ধরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মোটরযানের ফিটনেস নবায়ন করা হয়নি। এ অবস্থায় মোটরযান মালিকদের স্ব-স্ব মোটরযানের ফিটনেস নবায়নের জন্য অনুরোধ করে বারবার আদেশ দিয়েছে বিআরটিএ।

১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে ফিটনেসবিহীন মোটরযান ধ্বংস বা চিরতরে ব্যবহারের অযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করছে বিআরটিএ। এসব মোটরযানের নিবন্ধন বাতিলের কার্যক্রম শুরু করেছে সংস্থাটি। এটি করা হচ্ছে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ২৪ ধারা অনুযায়ী।

বিআরটিএ’র মোটরযান পরিদর্শকরা জানান, কোনো গাড়ি সড়কে চলাচলের উপযোগী কি না, তা যাচাই করার জন্য গাড়ির ৩২টি বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে হয়। সব বিষয় খালি চোখে ধরা পড়ে না। মিরপুর ছাড়া বাকি সব সার্কেল অফিসে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করা হয় চোখে দেখে।

চোখে শুধু গাড়ির বডি, চেসিস নম্বর, ইঞ্জিনের অবস্থা, হেডলাইট ও লুকিং গ্লাস— এ ধরনের ছয়-সাতটি অবস্থা দেখে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা যান্ত্রিক উপায়ে করতে ১৯৯৪ সালে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০০৪ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট পাঁচটি সেমি অটোমেটিক (আধা-স্বয়ংক্রিয়) ভেহিকল ইন্সপেকশন সেন্টার (ভিআইসি) বা যানবাহন পরীক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত শুধু বিআরটিএ’র মিরপুর কার্যালয়ে এ কেন্দ্র চালু হয়।

জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৯৮ সাল থেকে অংশীজনদের নিয়ে সভা করে থাকে। এসব সভায় বারবার অনুপযোগী যানবাহন উচ্ছেদের সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১০ সালে রাজধানীতে ২০ বছরের অধিক পুরনো বাস-মিনিবাসের চলাচল নিষিদ্ধ করে অভিযানও শুরু হয়। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। অভিযান চালানো হলে বাসমালিকরা বিভিন্ন কৌশলে ধর্মঘট শুরু করে দেন। ফলে অভিযান স্তিমিত হয়ে পড়ে।

দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে অন্তত পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ৭৭টি / ছবি- সংগৃহীত

২০১২ সালের এপ্রিলে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা কমিটির সভায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৩ সালের জুনে কমিটির সভায় তিন মাসের মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ি অপসারণের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু এসব কেবল ঘোষণাতেই আটকে আছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতউল্ল্যাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ দেওয়ার জন্য আমরা সরকারের কাছে বছরের পর বছর ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। গাড়ি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে ঢাকা থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি উচ্ছেদ করা সম্ভব। শুধু বাস নয়, লেগুনাসহ বহু অননুমোদিত গাড়ির ফিটনেস নেই।

ড্রাইভার্স ট্রেনিং সেন্টারের চেয়ারম্যান নুর নবী শিমু বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশে বিআরটিএ’র অননুমোদিত গাড়ি রয়েছে কমপক্ষে ১০ লাখ। এর মধ্যে নছিমন, করিমন ও ভটভটির মতো যানবাহনও আছে। এগুলোর নিবন্ধন ও ফিটনেস নেই। দুর্ঘটনার সঙ্গে এসব বাহন জড়িত। কম গতিসম্পন্ন এসব বাহনের হিসাব বিআরটিএ সংরক্ষণ করছে না। এটি করলে ফিটনেসহীন গাড়ির সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যেত।

পিএসডি/আরএইচ