প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বড় শিল্পের পাশাপাশি আমাদের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প গড়ে তোলা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রোববার (৫ ডিসেম্বর) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নবম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলা-২০২১ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে বক্তব্য রাখেন তিনি। 

শেখ হাসিনা বলেন, বড় শিল্পের পাশাপাশি আমাদের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প গড়ে তোলা দরকার। এতে একদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে অপর দিকে মানুষ এই স্বল্প পুঁজি দিয়ে কিছু উৎপাদন করতে পারবে, বাজারজাত করতে পারবে, আর্থিকভাবে সফলতা অর্জন করতে পারবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি। 

তিনি বলেন, সমগ্র বাংলাদেশে যাতে এই শিল্পায়নটা হয়, একটা জায়গায় শুধু নয়, তার জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য, দেশটাকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং শিল্পখাতে আমাদের উন্নতি করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন, মানুষের আয় বৃদ্ধি করা, দারিদ্র্যের হাত থেকে এই দেশের মানুষকে মুক্ত করা। পাশাপাশি আমাদের নারী সমাজ, তারাও যেন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছলতা অর্জন করতে পারে। যেটা তার সংসারের কাজে লাগবে আবার দেশেরও কাজে লাগবে। এভাবে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি।

তিনি বলেন, যত্রতত্র শিল্প করা যাবে না। এটা বাস্তব। কারণ আমরা চাই আমাদের কৃষি জমি রক্ষা করতে। খাদ্য চাহিদা কখনোই কমবে না। বরং দিনের পর দিন বাড়বে। চাষ উপযোগী জমি রক্ষার্থে আমরা কাজ করব।

শেখ হাসিনা বলেন, সারা দেশে ১০০টি শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলেছি। জাতির পিতা যে বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তুলেছিলেন, সেগুলোও সম্প্রসারণ করছি। তাই সুনির্দিষ্ট জায়গায় সেই শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। যাতে করে বর্জ্য ব্যবস্থা, পরিবেশ ঠিক থাকে, পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়, সেই দিকে নজর দিতে হবে। 

তিনি বলেন, যত্রতত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান না করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প তো নিজেরাই করতে পারেন। এসএমই ফাউন্ডেশনকে বলব, আপনারা এ ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি দেবেন। যাতে কেউ যদি উদ্যোক্তা হয় তাকে কোথায় তার এই কাজগুলো করতে পারে সেই নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করে দেওয়া। নিজস্ব জমি কিংবা নিজের ঘরে করলে, সেখানেও বর্জ্য ব্যবস্থা কীভাবে করবে, কীভাবে করলে বাজারজাত করতে পারবে সেটা ভালোভাবে দেখতে হবে। 

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অঞ্চলভিত্তিক কিছু পণ্য উৎপাদিত হয়। সেগুলোকে কাজে লাগাব কিংবা তার ভিত্তিতে ওইসব অঞ্চলে শিল্প গড়ে তুলব। যাতে কাঁচা পণ্য আমরা নিজ দেশ থেকে আহরণ করতে পারি, সেই দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
 
সরকার কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে নজর দিচ্ছে জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, আমরা মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সবজি থেকে সবকিছু উৎপাদন বাড়াতে পেরেছি। কাজেই উদ্বৃত্ত যে পণ্য রয়েছে তাকে প্রক্রিয়াজাত করে বাইরে রপ্তানি করা যায় কি না দেখতে হবে। এছাড়া আমাদের দেশেও বাজার সৃষ্টি হচ্ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে।

তিনি বলেন, দেশের ৯৯ দশমিক ৭৫ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে। আমরা শতভাগ বিদ্যুৎ দেবো, সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব শতবর্ষে এটাই আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য আমরা অর্জন করব। পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে দিয়েছি। যাতে পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে কোনো সমস্যা না থাকে, সে বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছি। 

শেখ হাসিনা বলেন, খাদ্যের বাজারটা চিরদিনই থাকবে। দেশের মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়ছে। খাদ্য ও পুষ্টি জ্ঞান সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন, আরও সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি আমরা খাদ্য পণ্য বিদেশে রফতানি করতে পারব। পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে পৃথিবীর কোন দেশে, কী চাহিদা আছে সেই মোতাবেক আমাদের দেশের কোন পণ্য, কাঁচামাল পাওয়া যেতে পারে ওইগুলো বিবেচনা করে আমরা সহজে শিল্প গড়ে তুলতে পারি। তাতে আমাদের দেশের বাজার সম্প্রসারণ হবে। বিদেশেও পণ্য রফতানি করতে পারব। 

করোনাভাইরাসের পর খাদ্যের চাহিদা আরও বেড়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক উন্নত দেশ এখন খাদ্য সংকটে ভুগছে। আমাদের এখানে নেই। কারণ করোনার শুরু থেকেই আমরা নির্দেশনা দিয়েছি খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য। সংশ্লিষ্টরা সেই রকম ব্যবস্থা নিয়েছেন, তাই আমরা এখনো ভালো অবস্থানে রয়েছি। 

পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে মান ঠিক রাখার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বিষয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ অনেক বেশি প্রয়োজন। 

চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য দেশের তরুণ সমাজের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নিজে কাজ করবেন, অন্যকে কাজের সুযোগ করে দেবেন।  
 
এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উৎপাদিত পণ্যের প্রসার, প্রচার ও বাজারজাত করণের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। 

নারী উদ্যোক্তারা একসময় পিছিয়ে ছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের মাঝে খুব একটা উদ্যোক্তা ছিল না। এখন তারা এগিয়ে আসছেন। নারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে এসএমই ফাউন্ডেশন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আশা করি সামনের দিকে আরও বেশি নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। 

পুরুষদের পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারাও ব্যবসা করুন। স্ত্রীর নামে এই ফাউন্ডেশন থেকে ঋণ নিয়ে তাকেও একটু কাজ করার সুযোগ করে দিন। তাহলে সংসারের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়নও করতে পারবে। এতে উদ্যোক্তাও সৃষ্টি হবে। এই সুযোগে বাধা দিয়েন না। 

নারী উদ্যোক্তারা যেন বিশেষভাবে সুবিধা পায় সেই দিকে খেয়াল রাখার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। বিসিক শিল্পনগরী ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ সুযোগ দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। 

সারা দেশে ৭৮ লাখ এসএমই শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন মানুষ কাজের সুযোগ পেলে ৭৮ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। এই খাতের উন্নয়নের জন্য আমরা সবধরনের সহায়তা দিয়ে যাব।

বদলে যাওয়া বাংলাদেশ হলো বাস্তবতা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৭-০৮ সালে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ১৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩৪ দশমিক ৯৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শুধু জিডিপি বৃদ্ধি নয়, অর্থনৈতিক অনেক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। 

সরকার এসএমই নীতিমালা প্রণয়ন করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ খাত জাতীয় আয়ে ২৪ শতাংশ অবদান রাখছে। আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে ৩২ শতাংশে উন্নীত করতে চাই।

শেখ হাসিনা বলেন, ৯৬ সালে আমি ক্ষমতায় এসে বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করি। কর্মসংস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করি, যাতে যুবকরা বিনা জমানতে ঋণ পায়। নিজেরা উদ্যোক্তা হতে পারে। সেই সঙ্গে সঙ্গে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্যও আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। 

অনেক বিদেশি উদ্যোক্তারা দেশের এসএমই খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের বন্দর, বিমানে সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করেছি। এমনকি রেলওয়েকেও উন্নত করছি। সেখানেও পণ্য সরবরাহের সুযোগ থাকবে। বিদেশিরা এসএমই খাতে বিনিয়োগ করতে চান। এটা ভালো দিক। আমরা তাদের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছি।

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন, এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. মো. মাসুদুর রহমান।

অনুষ্ঠানে চার বর্ষসেরা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাকে পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শিল্পমন্ত্রী এই পুরস্কার তুলে দেন।

এইউএ/ওএফ/জেএস