ভূমিকম্প জোনে চট্টগ্রাম, ঝুঁকি বিবেচনায় এখনই সতর্ক হওয়ার পরামর্শ
পরপর দুটি ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম শহরসহ আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। টানা এই ভূকম্পন বড় ভূমিকম্পের আভাস কি না, এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন অবস্থানগত কারণে রিখটার স্কেলে সাত দশমিক পাঁচ থেকে আট দশমিক পাঁচ মাত্রার বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে চট্টগ্রাম। এই মাত্রায় ভূমিকম্প হলে নগরীর দেড় লাখ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এক্ষেত্রে ভূমিকম্প সহনীয় নয় এমন ভবন চিহ্নিত করে সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
চট্টগ্রাম মহানগরীর ৭৮ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। নগরীর এক লাখ ৮২ হাজার ভবনের মধ্যে এক লাখ ৪২ হাজারই ভূমিকম্প-ঝুঁকিতে আছে- আর্থকোয়াক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা
চুয়েটের সাবেক ভিসি এবং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি)-এর উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে বাংলাদেশ-মিয়ানমার, বাংলাদেশ-ভারত এবং মিয়ানমার-ভারত (পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বে) সীমান্ত এলাকায়। এসব এলাকায় ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে। আর তা হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার। চট্টগ্রাম নগরীর দুই লাখ বিল্ডিংয়ের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ ভবন ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
তিনি বলেন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের যেসব ভবন ও স্থাপনা রয়েছে সেগুলোর ভূমিকম্প প্রতিরোধী শক্তি যাচাই-বাছাই করতে হবে। এই স্থাপনাগুলোর অ্যাসেসমেন্ট করতে হবে। আমাদের গাইডলাইন আছে ভূমিকম্প অ্যাসেসমেন্ট করার। ভবনগুলো অ্যাসেসমেন্ট করে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা আছে কি না যাচাই করতে হবে। তারপর শক্তি বৃদ্ধি করার প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
চট্টগ্রাম নগরীর ৭০ শতাংশ ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে বলে মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, এরমধ্যে যে ভবনগুলো ঝুঁকিতে আছে, সেগুলোর শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এ ধরনের কাজে বিভিন্ন দেশে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও এ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
চুয়েটের সাবেক এই ভিসি বলেন, কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে ডিপ সি পোর্ট, বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প ও চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে যে শিল্পকারখানা তৈরি করা হচ্ছে সেগুলোতে যেন ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা থাকে। বিল্ডিং কোড ২০২০ অনুযায়ী যেন নতুন স্থাপনার ডিজাইন করা হয়।
ভূমিকম্প হলে তার পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও প্রস্তুতি সংশ্লিষ্ট সংস্থার নেই বলে মনে করেন চুয়েটের সাবেক এই ভিসি। তিনি মনে করেন, ভূমিকম্পের বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা দরকার। ভূমিকম্প হলে আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকে। উদ্ধার করার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি দরকার তা ক্রয় করতে হবে দ্রুত।
গত ২৬ নভেম্বর (শুক্রবার) ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূকম্পন অনুভূত হয়। ইউরোপিয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টার বলছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল চট্টগ্রাম থেকে ১৭৫ কিলোমিটার পূর্বে। ভূপৃষ্ঠ থেকে এর গভীরতা ছিল ৪২ কিলোমিটার।
এরপর শনিবার (২৭ নভেম্বর) বিকেল ৩টা ৪৭ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে চট্টগ্রামে আবার মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ৪ দশমিক ২ বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর।
পরপর দুটি ভূমিকম্পের বিষয়ে চুয়েটের সাবেক ভিসি মো. জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই দুটি ভূমিকম্প নিশ্চিতভাবেই যে বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিচ্ছে তা নয়। তবে ঝুঁকি অবশ্যই আছে। যে এলাকা থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে তা কিন্তু আগেই চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই অঞ্চল থেকে ভূমিকম্প আবারও হতে পারে।
কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) পরিচালিত ‘আর্থকোয়াক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ সেন্টার’-এর (ইইআরসি) এক গবেষণায় পাওয়া গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরীর ৭৮ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। গবেষণায় বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরীর ৪১ ওয়ার্ডের এক লাখ ৮২ হাজার ভবনের মধ্যে এক লাখ ৪২ হাজারই ভূমিকম্প-ঝুঁকিতে আছে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভূ-অভ্যন্তরে টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষই ভূমিকম্পের কারণ। তারা বলেন, টেকটনিক প্লেটগুলোর সংযোগস্থল বা ফল্ট লাইনের ওপর থাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বা ইপিআই-হাইপো সেন্টার।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব আর্থকোয়াক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রহমান ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভূমিকম্পের জন্য যে কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ ফল্ট লাইন আছে তার বেশ কয়েকটা বাংলাদেশের আশপাশে অবস্থান করছে। চট্টগ্রাম অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় পড়েছে। এই অঞ্চলে যে ফল্ট লাইন আছে তাতে ৭.৫ থেকে ৮.৫ মাত্রায় ভূমিকম্প হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ভূ-স্তরের ইউরোশিয়ান বা বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের ভূ-অবস্থানগত ভূমিকম্প জোনের মধ্যেই রয়েছে চট্টগ্রাম। এগুলোর সংযোগস্থল আশপাশের এলাকাতেই। তাই বলা যায় এই জোনটা ভেরি অ্যাক্টিভ।
তিনি বলেন, শুক্রবার যে এলাকা থেকে ভূমিকম্প হয়েছে ভবিষ্যতে সেখান থেকে আরও বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এসব ভূমিকম্প জানান দিচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য এখনই সতর্ক হতে হবে।
চুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর যেসব ভবন ভূমিকম্প সহনীয় নয় সেগুলোকে ভূমিকম্প সহনীয় করতে হবে। সরকারি-বেসরকারিভাবে নতুন যেসব ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলোতে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসরণ করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তিনি বলেন, শুক্রবারের ভূমিকম্পে আমাদের একটি প্রকৃতিগতভাবে টেস্ট (পরীক্ষা) হয়ে গেছে। প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরের একটি ভূমিকম্পই যদি আমাদের এই ঝাঁকুনি দেয়, বড় ভূমিকম্প হলে কী হবে? যদি ৭ মাত্রায় ভূমিকম্প হয় তাহলে সেটা হবে গত শুক্রবারের ভূমিকম্পের চেয়ে ৩২ গুণ বেশি শক্তিশালী। তখন আমাদের অবস্থা কী হবে তা এখনই ভাবতে হবে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ১৭৬২ সালে এই এলাকায় বড় একটা ভূমিকম্প হয়েছিল। যার মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮। তারপর কিন্তু এ অঞ্চলে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প হয়নি। এ বছর ৬ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প হলো। সব মিলিয়ে আমাদের অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে।
জানা গেছে, ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম নগরের হামজারবাগে সওদাগর ভিলা নামে পাঁচতলা একটি ভবন ধসে পড়ে। এ ঘটনায় ২৩ জন নিহত হন। বর্তমানেও শহরে অসংখ্য বহুতল ভবন আছে, যেগুলো বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করা হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ভবন ধসের ঝুঁকি আছে। সবশেষ ২৬ নভেম্বরের (শুক্রবার) ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম নগরীতে দুটি ভবন হেলে পড়েছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ডেপুটি চিফ টাউন প্ল্যানার ঈশা আনসারি ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে কী পরিমাণ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আছে তার তালিকা আমাদের কাছে নেই। এই কাজের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত লোকবলও নেই।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো আরও ভূমিকম্প সহনশীল করার বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ কাজ সিটি করপোরেশন করতে পারে। আমাদের লোকবল সংকট আছে। বাংলাদেশের দুর্যোগ মন্ত্রণালয় আছে, তাদের এই বিষয়ে প্রকল্প নেওয়া উচিত।
ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার সময় ভূমিকম্প-সহনীয় বিল্ডিং তৈরির বিষয়টি দেখা হয় কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী আমরা ভবন নির্মাণের অনুমতি দিই।
এই বিষয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি তা ধরেননি।
কেএম/এইচকে/