কাগজে-কলমে লেখা না থাকলেও ঢাকাকে সবাই ‘পুরান ঢাকা’ আর ‘নতুন ঢাকায়’ ভাগ করে ফেলেছে। ওয়ারী, গুলিস্তান, চাঁনখারপুল, বকশিবাজার, আজিমপুর পেরোলেই দেখা মেলে পুরান ঢাকার। এসব এলাকা বাদে বাকি সবই নতুন ঢাকা। 

কেউ কাজে, কেউ ঘুরতে আবার কেউ মুখরোচক খাবারের স্বাদ নিতে পুরান ঢাকায় যান। পুরান ঢাকায় খেতে গেছেন অথচ নাজিরাবাজার আর কাজি আলাউদ্দিন রোড চেনেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই নামে না চিনলেও ‘হাজি বিরিয়ানির সামনে’ বললে অবশ্যই চিনবেন। 

পুরান ঢাকায় দর্শনীয় স্থানের অভাব না থাকলেও নাজিরাবাজারকে একটু আলাদা করেই দেখতে হয়। নতুন ঢাকার অনেকেই প্রথমবারের মতো পুরান ঢাকায় ঢুঁ মারেন কেবল নাজিরাবাজারের খাবারের স্বাদ নিতে। এই সড়ক ঘিরে নতুন ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ নামকরা সব বিরিয়ানি-কাবাব, লাচ্ছি, মিষ্টি আর পানের দোকান।

আগতরা এখানে গাড়ি আর মোটরসাইকেল নিয়ে আসেন। হেঁটে হেঁটে দোকান ঘোরেন, খাওয়াদাওয়া করেন। ছবি তুলে চলে যান। যতক্ষণ থাকেন সময় কাটান উৎসবের আমেজে। একেবারে যেমনটি হয় মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বুকিত বিনতাংয়ে। নাজিরাবাজার হতে পারে বাংলাদেশের অফিসিয়াল ‘ফুড স্ট্রিট’। 

কাজী আলাউদ্দিন রোড, বংশাল, ফ্রেন্স রোড এলাকা নিয়ে ঐতিহ্যবাহী নাজিরাবাজার এলাকা। মূলত এই তিন সড়কেই বাংলাদেশের সেরা সেরা বিরিয়ানি ও কাবাবের দোকানগুলো। বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত খাবারের পাশাপাশি সাদা ভাত-ভর্তা, থাই, চাইনিজ, মাঠা, ছানা এবং সব রকম ফলও পাওয়া যায় এখানে। দাম যেমনই হোক, মান আর স্বাদে ভুলে অভিযোগ থাকে না।

ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে যানবাহন নিয়ে আসা যায় নাজিরাবাজার সড়কে। যারা ঝামেলামুক্ত আর নিশ্চিন্তভাবে খেতে চান, তারা ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজারের সামনে গাড়ি রেখে আসেন। 

এই এলাকার অধিকাংশ দোকান প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে পরদিন রাত ৩ থেকে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে। ভোর ৫-৬টা পর্যন্তও খোলা থাকে কিছু দোকান।

নাজিরাবাজার হতে পারে অফিশিয়াল ‘ফুড স্ট্রিট’
গত বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) রাতে নাজিরাবাজারে আসা গুলশানের বাসিন্দা তারেক আজম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভোজনরসিক মাত্রই পুরান ঢাকায় আসেন। পুরান ঢাকার সব ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায় নাজিরাবাজার সড়কে। কেউ এখানে এলে খালি মুখে ফেরেন না। খাবারের সঙ্গে এখানকার পরিবেশও উৎসবমুখর। পুরান ঢাকার লোকেরাও আন্তরিক, নিরাপত্তা নিয়েও আমরা নিশ্চিন্ত। ঢাকার খিলগাঁও, বেইলি রোড, মিরপুরেও এরকম খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে। তবে নাজিরাবাজারের মতো উৎসবমুখর পরিবেশ সেখানে নেই। ফুড স্ট্রিট ঘোষণা করে নাজিরাবাজারের সব দোকান এক ছাতার নিচে আনা যেতেই পারে।

মেহেদী আরেফিন নামে আরেক ভোজনরসিক বলেন, আমি বাড্ডা থেকে এসেছি। অনেকেই পুরান ঢাকার নাম শুনলে যানজটের ভয় পান। তবে নাজিরাবাজারের সড়কটি পুরান ও নতুন ঢাকার সীমান্তে। যে কেউ চাইলে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত গাড়িতে এসে সামান্য হেঁটেই নানা পদের খাবারের স্বাদ নিতে পারবেন। সড়কটিকে অবশ্যই ফুড স্ট্রিট ঘোষণা করে একটি কাঠামোতে নিয়ে আসা দরকার। 

জাঁকজমকপূর্ণ ‘ফুড স্ট্রিটে’ আছে সব 
বৃহস্পতিবার রাতে নাজিরাবাজারের উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা গেল সরেজমিনে। রাত যত বাড়ে ততই যেন জেগে ওঠে এই সড়ক। ভোজনপ্রিয়রা মজেন খাবারের ঘ্রাণ ও গন্ধে। মনকাড়া আলো ঝলমলে সড়কের মোড়ে মোড়ে সন্ধ্যার পর থেকেই ভিড় দেখা যায় ফুড লাভারদের।

ফুলবাড়িয়ার ফায়ার সার্ভিসের সড়ক থেকে নাজিরাবাজারের দিকে যেতে প্রথমেই হাতের ডানে পড়বে সড়কের প্রথম দোকান ‘হোটেল ওয়ান স্টার’। এখানে ভাত, মাছ, মাংস, মোরগ পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, লাচ্ছি, ফালুদা, চা, রুটি সবই পাওয়া যায়। একবার কেউ রেস্টুরেন্টটিতে ঢুকলে খালি মুখে ফেরা সম্ভব না। এরপর কিছু দূর হাঁটলে হাতের ডানে ঐতিহ্যবাহী ‘বিউটির লাচ্ছি’। মাত্র ৪০ টাকায় স্পেশাল লাচ্ছির সাথে তাদের রয়েছে কাচ্চি বিরিয়ানি-ফালুদা। বিউটির পাশেই একই ধরনের পানীয়র সমাহার নিয়ে বসেছে ‘গাউছিয়া লাচ্ছি’। বাম পাশে ৩-৪টি সাদা ভাত-ভর্তা ও রুটির দোকান। পাশেই সুপরিচিত ‘পান্নু খানের টি স্টল’। এখানে ১০ টাকার চা খেতে ফুটপাত ছাড়িয়ে রাস্তায়ও চলে আসে।

একই সড়ক ধরে সামনে গেলে হাতের ডানে ঐতিহ্যবাহী ‘হাজি বিরিয়ানি’। তার ঠিক বিপরীতে ‘আদি হাজি বিরিয়ানি’। হাজির সঙ্গে ‘আদি’ শব্দ যুক্ত করলেও ‘আসল’ হাজি বিরিয়ানির মতো ভিড় চোখে পড়ে না সেখানে। পুরান সেই জরাজীর্ণ টেবিল-চেয়ারে বসেই খেতে দেখা যায় সবাইকে। অনেকে আবার খেয়ে ঐতিহ্যবাহী কাঁঠালপাতার প্যাকেটে বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন বিরিয়ানি। পাশেই ‘হানিফ বিরিয়ানি’। খাসির মাংসের বিরিয়ানি জন্য হাজি থেকেও হানিফের জনপ্রিয়তা বেশি।

আরেকটু সামনে গেলেই বামে পড়বে ঐতিহ্যবাহী ‘আলাউদ্দিন সুইটস’, ডান পাশে ‘বুখারী বিরিয়ানি’ ও ‘হাজি নান্না বিরিয়ানি’। এই দুটি দোকান অবশ্য বাসমতী চালের কাচ্চি বিরিয়ানি ও মোরগ পোলাওয়ের জন্য প্রসিদ্ধ। সাথে বোরহানি আর দুধ-বাদামের সরবত বিখ্যাত তাদের। একই পাশে রয়েছে সফট আইসক্রিমের দোকান। 

হাঁটতে হাঁটতে নাজিরাবাজার মোড়ে আসার পর বাম দিকে দেখা মিলবে ঐতিহ্যবাহী ‘বিসমিল্লাহ কাবাব’সহ বেশ কয়েকটি দোকানের। গরু-মুরগির চাপ, গুর্দা, গরুর বটি কাবাব ছাড়াও হরেক খাবার বিক্রি হয় এখানে। পাশেই ঐতিহ্যবাহী বাকরখানির দোকান। 

আর চৌরাস্তা থেকে ডানে বাংলাদেশ মাঠের সড়কে গেলে পাওয়া যাবে ‘মামুন’, ‘মতি’, ‘মদীনা’, ‘খুশবু’, ‘কাশ্মীর’সহ বেশ কয়েকটি তেহারির দোকান। সেখানে হরেক রকমের কাচ্চি, মোরগ পোলাও, খিচুড়ির স্বাদও দারুণ।

এসব দোকানে খাবারের ব্যবস্থা স্বাভাবিক হোটেলের মতো। যারা একটু প্রাইভেসি নিয়ে এসির বাতাসে খেতে চান তাদের জন্য রয়েছে ‘গ্র্যান্ড নবাব’ ও ‘টেস্ট অব নবাব’। এসব দোকানের মেন্যুতে রয়েছে মোরগ পোলাও, তেহারি আর বাসমতী চালের কাচ্চি। 

যারা সি-ফুড বা সামুদ্রিক মাছসহ অন্যান্য খাবার খেতে চান তাদের জন্য ‘রয়েল সুইট কাবাব কিং অ্যান্ড সি ফুডে’ রয়েছে বিশাল সম্ভার। 

এছাড়া ৮-১০টি দোকানে চা-কফি, মিল্কশেকসহ প্রায় শতাধিক রকমের সফট ড্রিংক পাওয়া যায়। আছে ঐতিহ্যবাহী শাহী পান, আগুন পানসহ প্রায় ২০-২৫ রকমের মুখরোচক পান। 

খাবারদাবারের সময় যাতে আগতদের গাড়ি পার্কিংয়ের অসুবিধা না হয় সেজন্য নাজিরাবাজারের আব্দুল্লাহ টাওয়ারের একটি নির্মাণাধীন ভবনে পার্কিংয়েরও ব্যবস্থা রয়েছে।

আল-আমিন কাবাবঘরের ম্যানেজার আয়নাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে শুধুমাত্র পুরান ঢাকার লোকজন এই সড়কে খেতে আসতেন। বর্তমানে নতুন ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকেও এখানে লোকজন আসেন। সারা রাত থাকেন। নিরাপদে খেয়ে বাড়ি ফিরে যান। এটাকে খুব সহজেই ব্র্যান্ডিং করা যায়। 

‘বর্তমানে রাতভর দোকান করতে আমাদের অনেক সমস্যা হয়। অনুমোদন না থাকায় পুলিশের বাধায়ও পড়তে হয়। যদি এটাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফুড স্ট্রিট করা হয় তাহলে আমরাও সরকারি নির্দেশনা মেনে একটি কাঠামোর মধ্যে ব্যবসা করতে পারব।’

বর্তমানে পুরান ঢাকায় মূল্যবান অনেক স্থাপত্য থাকলেও পর্যটনের ক্ষেত্রে এগুলো থেকে আয় প্রায় শূন্য। নাজিরাবাজারকে যদি আনুষ্ঠানিকভাবে ফুড স্ট্রিট হিসেবে ঘোষণা করা যায় তাহলে এসব সড়কের ঐতিহ্যবাহী দোকানগুলো থেকে প্রতিটি খাবার অর্ডারের বিল কিংবা মাসিক ভিত্তিতে দোকানগুলো থেকে রাজস্ব আয় করা সম্ভব। পাশাপাশি এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন এই এলাকাগুলো পৃথিবীর মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে।

ঢাকার রাতের বিনোদনস্থল নাজিরাবাজার
দিনের বেলায় যানজটের ভয়ে যারা পুরান ঢাকায় আসতে চান না রাতে তাদের নাজিরাবাজারের ফুড স্ট্রিটে এনে নাইট ট্যুরের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। ইতোমধ্যে ঢাকা পোস্টকে এসব পরিকল্পনার কথা বলেছে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ট্যুর অপারেটর।

‘অ্যামেজিং ট্যুরের’ ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে বিদেশি ট্যুরিস্টরা দিনের বেলায় পুরান ঢাকার লালবাগের কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, তারা মসজিদ, চকবাজার শাহী মসজিদসহ বেশ কয়েকটি স্পটে যেতে পছন্দ করতেন। বর্তমানে তারা আর যেতে চান না। এ কারণে আমরা রাতে ট্যুর আয়োজনের কথা ভাবছি।

‘দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে রাতে পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী, বাদামতলীর ফলের আড়ত, নাজিরাবাজারের বিরিয়ানির সমাহার, আহসান মঞ্জিল, পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনসহ বেশ কয়েকটি সড়ক ও স্থাপনা ঘুরানোর পরিকল্পনা করেছি। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে শিগগিরই এসব প্যাকেজ চালু করা হবে।’

ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিজাব) সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুল ইসলাম বুলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, পর্যটকরা এসব জায়গায় (পুরান ঢাকায়) যেতে চান। সরকার যদি ব্যবস্থা করে দিতে পারে তাহলে ট্যুরিস্ট আসবে। ঢাকার প্রধান সমস্যা ট্রাফিক। পুরান ঢাকায় মুভ করতে হলে রিকশাই ভরসা। সেজন্য সুসজ্জিত রিকশা তৈরি করতে হবে, চালকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা চাই ট্যুরিজম বোর্ড এদিকে নজর দিক। পুরান ঢাকার কিছু ভ্যান্ডরও রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণ দিক। প্রয়োজনে আমরাও সহযোগিতা করব। তাদেরকে কথা দিতে হবে যে তারা জোরে রিকশা চালাবে না, একজন আরেকজনকে ওভারটেক করবে না। এ ধরনের ছিমছাম উদ্যোগ নিলে অনেক পর্যটক পাওয়া যাবে।

পুরান ঢাকার কসাইটুলি পঞ্চায়েত কমিটির সদস্য জাফর আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৮-১০ বছর আগেও পুরান ঢাকায় অনেক পর্যটক আসতেন। এখন আর আসেন না। সরকার যদি পুরান ঢাকায় পর্যটক ফেরানোর উদ্যোগ নেয় তাহলে আমরা তাদের সর্বোচ্চ সহায়তা করব। 
 
এআর/এইচকে/