কারা বিদেশে টাকা পাচার করে জানেন না অর্থমন্ত্রী
কারা বিদেশে টাকা পাচার করে তা জানেন না বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
শনিবার (২৭ নভেম্বর) জাতীয় সংসদে একটি বিল পাসের আলোচনায় বিরোধী দলের সদস্যদের বক্তব্যের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ কথা জানান।
বিজ্ঞাপন
টাকা পাচার প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, অনেকভাবে বলেছেন, এই সংসদেও বলেছেন, দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। আমি আপনাদের বলেছি, যারা পাচার করে তাদের তালিকা আমাকে দেন। আমি তো পাচার করি না। আমি বিশ্বাস করি আপনারাও পাচার করে না। সুতরাং, পাচার কে করে, আমি জানব কেমন করে, যদি আপনারা (তালিকা) না দেন?
এ সময় বিরোধী দলের সদস্যদের অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে কিছু বলতে দেখা যায়। তবে তাদের মাইক বন্ধ থাকায় তাদের বক্তব্য শোনা যায়নি। তাদের কথার প্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী বলেন, হ্যাঁ, ইয়েস, আপনারা বলেন। আপনারা পাচারকারীদের তালিকা দেন।
তখন একজন সদস্য বলেন, এটা অর্থমন্ত্রী বলবেন কারা পাচার করে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, না, অর্থমন্ত্রী বলতে পারবে না। একটা কথা আমি আবারও বলি, আপনারা-আমরা কিন্তু একই পথের পথিক। আপনি যেটা জানেন আমিও সেটা জানি। বারবার আমি বলেছি, আমি জানি না। আমাকে জানান।
এ পর্যায়ে বিরোধী দলের একজন সদস্য কিছু একটা বলেন। জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ঠিক আছে, প্লিজ কাম উইথ এ লিস্ট (তালিকা নিয়ে আসুন)।
এ সময় বিরোধী দল থেকে কিছু একটা বলা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, আরে আবার এক কথা! আমিতো বলছি, আমি (তালিকা) কোথায় পাব? আপনি আমাকে বলেন। আচ্ছা ঠিক আছে, অলরাইট, আমি দেখব।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, একটি দেশের অর্থনীতির মূল চালক হলো সেদেশের ব্যাংকিং সেক্টর। সারা বিশ্বের অর্থনীতি যখন টালমাটাল অবস্থা সবাই কিন্তু বলছেন তখন আমরা ভালো করছি। আপনার কাছে যদি প্রমাণ থাকে যে, কোনো প্রতিবেশী দেশের চাইতে অর্থনৈতিক এলাকায় আমরা পেছনে আছি, তাহলে ইন দ্যাট কেস ইউ কাম টু মি, আই উইল গেট ইউ টু দ্যা সল্যুশন (আমার কাছে আসুন, আমি সমাধান করব)। অবশ্যই আমি দায়িত্ব নিয়ে সে কাজটি করব।
সংসদ সদস্যদের বক্তব্যে অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থনীতি এখন একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে। সারা বিশ্বের অর্থনীতি ৩ শতাংশ কনট্র্যাকশন হয়েছে। কিন্তু দেশে এটি হয়নি। বলা হচ্ছে, ২০৩৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিমাণ হবে সারা বিশ্বে ২৫তম।
অর্থমন্ত্রী বলেন, এই যে অর্জনগুলা, আপনারা যেভাবে বলেন মনে হয়- দেশে কোনো অর্থনীতি নাই, দেশে কোনো ব্যাংকিং খাত নাই, দেশে কিছুই নাই। কিন্তু কিছুই যদি না থাকবে এগুলো বাদ দিয়ে আমরা উন্নতি করছি কীভাবে। এগুলো বাদ দিয়ে আমাদের প্রবৃদ্ধি আসছে কীভাবে।
এমপিরা প্রশ্ন করলে প্রশ্নোত্তর পর্বে সব জবাব দেবেন মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, মনের মতো করে আপনারা প্রশ্ন করবেন। আমি প্রত্যেকটা প্রশ্নের জবাব দেব। আমি প্রশ্নের জবাব দেব সেদিন, যেদিন আপনারা প্রশ্ন করবেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে, গ্রাহক বেড়েছে, আমানত বেড়েছে।
অর্থমন্ত্রী দাবি করেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেশসৃষ্টির পর থেকে সবচেয়ে কম এখন। ২০০৬ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। এখন সেপ্টেম্বর কোয়ার্টার পর্যন্ত ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এটা ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। সবচেয়ে নিম্নে আছে এখন। প্রত্যেকটা ব্যাংক লাভে আছে। ঋণ নিয়ে যারা অনিয়ম করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ই-কমার্সের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। চলমান মামলা সংখ্যা ২ লাখ ৪৩ হাজার।
এর আগে বিলটি জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক বলেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ একলাখ কোটি টাকার বেশি। কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে রাজনীতিবিদ, আমলাসহ অনেকে টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ আছে। তারা বারবার অনুরোধ করেছেন, এটা নিয়ে তদন্ত হোক। কারণ এই অভিযোগে আমলা, রাজনীতিবিদদের বদনাম হয়। টাকা পাচার হয় কি না, হলে কারা করে এটা বের করতে তিনি ব্যাংক কমিশন গঠন করে তদন্ত করার দাবি জানান।
বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, অর্থমন্ত্রীকে আমরা অনেক প্রশ্ন করি, তিনি কোনো উত্তর দেন না। ঠান্ডা মাথায় এড়িযে যান।
তিনি বলেন, ই-কমার্সের নামে লুটপাট হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা জনগণরে কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলছেন, দায় তার না। বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, দায় তার না। তাহলে কে দায় নেবে?
বিএনপির মোশাররফ হোসেন বলেন, রাঘব বোয়ালরা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে মেরে দিয়ে আয়েশি জীবনযাপন করছে। গরিব মানুষ ঋণ পায় না। কৃষকদের অল্প টাকা ঋণ খেলাপি বারবার তার বাড়িতে যাওয়া হয়। হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করছে যারা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জাতীয় পার্টির রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, অর্থমন্ত্রী দক্ষ, জ্ঞান রাখেন, সহনশীল। কিন্তু ব্যাংকের অনিয়ম দুর্নীতি, পাচার হলে কত টাকা পাচার হয়েছে এসব বিষয়ে জানানো উচিত। এজন্য তিনিও একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবি জানান।
এসব বক্তব্যের জবাবে অর্থমন্ত্রী ছিলেন নির্বিকার। বিরোধী সাংসদের বক্তব্যের জবাব দিতে উঠে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল বলেন, যেহেতু বিলটি স্থায়ী কমিটিতে প্রেরিত হয়েছিল, সেখানে এটি পরীক্ষা করেছে। তাই যাচাইবাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।- এই বলে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।
এরপর সংশোধনী প্রস্তাব তুলতে গিয়ে বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, একলাখ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি। উত্তর দিলেন না অর্থমন্ত্রী। হাজার হাজার কোটি টাকা চলে গেল। দায় কে নেবে? এসব বিষয় জানাতে হবে। আশ্বস্ত করতে হবে।
হারুন বলেন, অর্থমন্ত্রী কথা কম বলেন, এটা ভালো। কিন্তু টু দ্যা পয়েন্ট উত্তর দিতে হবে।
বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, উনি (অর্থমন্ত্রী) কথা কম বলেন। বললে ভুল হবে। ওনি কথা বলেনই না প্রায়।
রুমিন বলেন, কাগজে-কালমে মন্দ ঋণ এক লাক কোটি টাকার মতো। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা ঋণ হিসাব করলে সেটা আসলে মোট সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, রাজনীতিবিদ ও আমলারা টাকা পাচার করেন শোনা যায়। কারা কত পাচার করে অর্থমন্ত্রী যদি পরিষ্কার চিত্র দেন তাহলে রাজনীতিবিদ ও সৎ আমলারা, মুক্ত থাকতে পারেন।
অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নান বলেন, কথা কম বলা ভালো। কিন্তু কিছুকিছু ক্ষেত্রে কথা বলতে হয়। অর্থমন্ত্রী যদি মাঝেমধ্যে খুলে বলেন ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন তাহলে মানুষ জানতে পারে। না হলে মানুষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়।
পরে সংশোধনী প্রস্তাবের বিষয়ে সদস্যদের বক্তব্যের জবাব দেন অর্থমন্ত্রী।
এইউএ/এইচকে