ওষুধ ‘অক্সি-মরফোন’ ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর মাদক হিসেবে
অক্সি-মরফোন তীব্র ব্যথানাশক একটি ওষুধ। যা ক্যানসার, হার্টসহ দুরারোগ্য রোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। তবে ইউফোরিক এই ড্রাগ ‘ক’ শ্রেণির মাদক হিসেবেও অন্তর্ভুক্ত। যে কারণে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার করা যায় না। তবে সম্প্রতি অক্সি-মরফোন ভয়ংকর মাদক হিসেবে ছড়িয়ে পড়ার তথ্য দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
ডিবি পুলিশ বলছে, মাদকসেবীরা অক্সি-মরফোন গুঁড়ো করে যেকোনো সিরাপ বা পানীয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেয়ে নেশাগ্রস্ত হচ্ছেন। যুব সমাজ, বিশেষ করে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এর ব্যাপক ব্যবহার গোয়েন্দাদের নজরে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর বলছে, মাদক হিসেবে অক্সি-মরফোনের ব্যবহার রোধে কাজ করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এটি ওষুধ হিসেবে বিক্রির জন্য তারা লাইসেন্স দিয়ে থাকে।
অক্সি-মরফোন মস্তিষ্কে প্রচণ্ড আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে। শরীরে সাময়িকভাবে দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা ভুলিয়ে দেয়। বিপথগামী শিক্ষার্থীরা ব্যাপক হারে অক্সি-মরফোন গুঁড়ো করে সিরাপ বা পানীয়র সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ওষুধ বিক্রি ও বাজারজাত করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট কোম্পানির কাছ থেকে লাইসেন্স দেখিয়ে তারা এ ওষুধ সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে সেসময় ওষুধ পরিবহনের রুট জানাতে হবে। এছাড়া ওষুধটি কার কাছে বিক্রি করা হবে তাও জানাতে হবে।
অক্সি-মরফোন তবু খোলা বাজার বিক্রি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বৃহৎ পরিসরে ক্যানসার ও হার্টের চিকিৎসা ঢাকায় হলেও এর লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ঢাকার বাইরেই বেশি।
কীভাবে বিপুল সংখ্যক ড্রাগ খোলা বাজারে মাদক হিসেবে বিক্রি হচ্ছে তা তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) রাজধানীর কোতোয়ালী ও ধানমন্ডি এলাকা থেকে ১৩ হাজার পিস অক্সি-মরফোনসহ আলমগীর সরকার ও জাহিদুল ইসলাম নামে দুজনকে গ্রেফতার করে ডিবি।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডিবি লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালী জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, কতিপয় ব্যক্তি বাবু বাজার এলাকায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ মাদকদ্রব্য অক্সি-মরফোন বিক্রির জন্য অবস্থান করছে- এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় অক্সি-মরফোনসহ আলমগীর ও জাহিদুলকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২০০০ পিস অক্সি-মরফোন উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যে রাতেই সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ধানমন্ডি শাখায় অভিযান চালিয়ে আরও ১১ হাজার পিস অক্সি-মরফোন উদ্ধার করা হয়।
তিনি বলেন, গ্রেফতারকৃতরা বিপুল পরিমাণে ভয়ংকর এই ড্রাগ সংগ্রহ করে মাদকসেবীদের কাছে বিক্রি করে আসছিল। তাদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় মামলা হয়েছে।
ক্যানসার ও হার্টের চিকিৎসা ঢাকায় বেশি হলেও ওষুধ অক্সি-মরফোনের লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বেশি ঢাকার বাইরে।
এ ব্যাপারে ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেফতার হওয়া আলমগীর ডেল্টা ড্রাগ করপোরেশনের মালিক এবং জাহিদুল ইসলাম জে ট্রেড ফার্মেসি ঢাকার মালিক। তিনি অক্সি-মরফোনের খুচরা বিক্রেতা। এই খুচরা বিক্রেতার সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়েই আমরা ভয়াবহ তথ্য পেয়েছি।
তিনি বলেন, চিকিৎসকদের তথ্যানুযায়ী অক্সি-মরফোন হলো মরফিনের একটি এনালগ, যা একটি এনালজেসিক ড্রাগ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি ইনজেকশন থেকে ওরাল ফর্মে নিয়ে আসা হয়েছে। এটি মূলত কাজ করে মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বা ব্রেইনে। একটি ইউফোরিক ড্রাগ হিসেবে এটি তীব্র ব্যথানাশক হিসেবে ক্যানসার, হার্ট, দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত মৃত্যু পথযাত্রী রোগীর তীব্র ব্যথা কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি ব্যবহারে মস্তিষ্কে প্রচণ্ড আনন্দের অনুভূতি তৈরি হয়। সাময়িকভাবে দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা ভুলিয়ে দেয়। ব্যথার সংকেত গিয়ে মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করতে পারে না। মস্তিষ্ক বোধহীন অসাড় হয়ে যায়।
গোয়েন্দা অনুসন্ধানে নেমে ডিবি পুলিশ জানতে পেরেছে, এটি নিয়ন্ত্রিত একটি ড্রাগ। যা সাধারণ খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতার কাছে থাকার কোনো সুযোগ নেই। দেশে একমাত্র জিসকা ফার্মা এটি উৎপাদন করে। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে উৎপাদন করে এবং নিজস্ব ডিলারের মাধ্যমে তা বিক্রি করে থাকে।
জিসকা ফার্মার তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ মাসে এই ওষুধ তৈরি হয়েছে ৫ লাখ পিস। এসব ওষুধ ১৫টি জেলায় বিপণনের জন্য সরবরাহ করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ১২০টি লাইসেন্স পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শুধু বরিশালেই লাইসেন্স আছে ৫০টি। এরমধ্যে বরিশাল মেডিকেল কলেজ রোডে ২০টি, খুলনায় ১৭টি, ঢাকায় ২৭টি ও রাজশাহীতে ৫টি প্রতিষ্ঠান এই ওষুধ বিক্রি করে।
হাফিজ আক্তার এ ব্যাপারে বলেন, এটি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় ও বিপণনের সুযোগ নেই। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে এটি যাচ্ছে মাদকসেবীদের হাতে। ক্যানসার ও হার্টের চিকিৎসা ঢাকায় বেশি হলেও কীভাবে অক্সি-মরফোন বিক্রির লাইসেন্স বরিশালে বেশি হলো, কীভাবে খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে, কারা মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যুব সমাজ যাতে এই ড্রাগ হাতে না পায় সেজন্য রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ও ওষুধ বিক্রেতাদের অনুরোধ জানান তিনি।
গত পাঁচ মাসে অক্সি-মরফোন তৈরি হয়েছে ৫ লাখ। ১৫ জেলায় বিপণনের জন্য সরবরাহ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. আইয়ুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ওষুধ হিসেবে এর ব্যবহার ও বিক্রির অনুমোদন দিয়েছি। যেটির বিপণনে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াও রয়েছে। এটির অনুমোদনের ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত মনিটরিং ও পরিদর্শন করে থাকেন ঔষধ প্রশাসনের পরিদর্শকরা।
তিনি বলেন, তবে এটি মাদক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে কি না সেটি দেখার দায়িত্ব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের। কারা মাদক হিসেবে ব্যবহার করছে সেটি তারাই দেখবে। তবে বিপণনের ক্ষেত্রে যদি অনুমোদনের বেশি মজুদ ও বিক্রির তথ্য আমরা পাই তাহলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা ও পুনর্বাসন) মো. মাসুদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অক্সি-মরফোন ওষুধ হিসেবে আমরা লাইসেন্স দিয়ে থাকি। আমরাও জেনেছি, এটি মাদক হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। যদি আমাদের কোনো কর্মকর্তার এমন অনৈতিক কাজে সংশ্লিষ্টতা পাই তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন স্বয়ং ডিজি মহোদয়। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি।
জেইউ/এইচকে/জেএস/ওএফ