টিকা প্রয়োগ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

অচেনা অজানা অদৃশ্য এক শত্রুর কবলে পড়ে হঠাৎ বদলে গেল পৃথিবী। কালো এক আধার ছেয়ে গেল পৃথিবীর এপাার থেকে ওপার। লাখে লাখে মানুষ মারা গেল, শেষ বিদায় জানানো হলো না প্রিয়জনদের। দিশাহীন এই পথে একবছরেরও বেশি সময় হেঁটেছে বিশ্ব। এবার বদলে যাওয়ার সময়, ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। বদলে যাওয়ার সেই সময়ের সঙ্গী হলো বাংলাদেশ। 

টিকার হাত ধরে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে করোনামুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়নে এবার সামিল হলো বাংলা। বুধবার বিকেলে দেশে করোনাভাইরাসের টিকা প্রয়োগ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এখন আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশ টিকাদান শুরু হবে।

ভারতের উপহার দেয়া কোভিশিল্ড নামের টিকা দিয়ে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হলো। এটা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত টিকা; যা তৈরি করেছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। উপহারের টিকার বাইরে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মার চুক্তি রয়েছে। 

টিকা প্রয়োগ কর্মসূচির উদ্বোধন ঘিরে সকাল থেকেই অন্যরকম ছিল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। হাসপাতাল ভবনের প্রবেশ মুখ থেকে ভেতরের মঞ্চ পর্যন্ত ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। টিকাদান কর্মসূচির দৃশ্য দেখানোর জন্যও বড় পর্দার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, আগামী বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাঁচ শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মীকে (চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া, পরিচ্ছন্নতা কর্মী) টিকা দেয়া হবে। এরপর আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশ টিকাদান শুরু হবে।

মার্চের ৮ থেকে জানুয়ারি ২৭ 
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন ২০২০ সালের মার্চের ৮ তারিখে, সে হিসেবে ক্যালেন্ডারের পাতায় সাড়ে ১০ মাসের বেশি সময় গেছে ইতোমধ্যে। এ ১০ মাসে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবেলার কাজে সরকার কতটা এগিয়েছে তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। তবে করোনা মোকাবিলার নানা পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে ঘাটতি থাকলেও বাংলাদেশের অবস্থা দৃশ্যত অনেকে দেশের চেয়েই সুবিধাজনক।  

সংক্রমণের গতি কমানো, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো ও রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তার অনেকটাই বাস্তবায়ন করা যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে অনেকের।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বরাবর দাবি করা হয়েছে, মহামারি মোকাবেলায় প্রতিবেশী অনেক দেশের চাইতে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে কোভিড ১৯ আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত হবার পর সংক্রমণের হার 'পিকে' বা শীর্ষে পৌঁছাতে আড়াই থেকে তিনমাস সময় লাগতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে শুরুতে বলা হয়েছিল ২০২০-এর এপ্রিলে সংক্রমণের পিক দেখা যাবে, পরে বলা হয় সেটি হবে মে মাসে। কিন্তু জুন এবং জুলাই মাসেও সংক্রমণ বাড়তে থাকে।

এরপর কখন বাংলাদেশ সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী শীর্ষ অবস্থানে অর্থাৎ পিকে উঠেছে, সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তবে গত কয়েকদিন ধরেই করোনা আক্রান্ত হয়ে দেশে মৃত্যু হার নিম্নমুখি, শনাক্তের হারও একই ধারা। ২০ জানুয়ারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে আটজনের মারা যাওয়ার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর; যা ছিল আট মামের মধ্যে সর্বনিম্ন মৃত্যু। এছাড়া ১২ জানুয়ারির তথ্যে দেখা যায় শনাক্তের হারও ৫ শতাংশে কম।   

এ পরিস্থিতিতে আজ ২৭ জানুয়ারি টিকা প্রদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হলো দেশে। 

ল্যাব টেস্টে উত্তীর্ণ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৫০ লাখ টিকা
এদিকে বেক্সিমকোর আনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৫০ লাখ ডোজ করোনা ভ্যাকসিন ল্যাব টেস্টে উত্তীর্ণ, মানবদেহে ব্যবহারের উপযুক্ত বলে জানিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

মহাখালীতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘টিকার প্রতিটি লটের নমুনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। এ টিকা ব্যবহারে বাধা নেই।’

‘সুরক্ষা’ অ্যাপ
প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের পরই সবার নিবন্ধনের জন্য খুলে দেওয়া হবে ‘সুরক্ষা’ অ্যাপ। কুর্মিটোলা হাসপাতালে টিকা প্রয়োগ প্রস্তুতি দেখতে এসে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের পর নিবন্ধনের জন্য সুরক্ষা প্ল্যাটফর্ম খুলে দেওয়া হবে। যারা নিবন্ধন করতে পারবেন না, তারা টিকা কেন্দ্র বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়েও নিবন্ধন করতে পারবেন। সেই ব্যবস্থা আমরা রেখেছি।

ভ্যাকসিন বিষয়ক সম্ভাব্য পরিকল্পনা
বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে বিশ্বের ৯২টি দেশের মতো দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর তথা ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সায়েন্টিফিকি অ্যাডভাইজরি গ্রুপ অব এক্সপার্টসের নির্দেশনা ও দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেওয়ার অগ্রাধিকার তালিকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ভ্যাকসিন বিতরণের ১ম পর্যায়ে দেশের জনসংখ্যার মোট ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মোট ২ ডোজ করে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।

দেশের ৬৪টি জেলা ইপিআই স্টোর এবং ৪৮৩টি উপজেলা ইপিআই স্টোরে এই ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা হবে।

চুক্তি অনুযায়ী সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে পাওয়া ৩ কোটি বা তার বেশি ডোজ ভ্যাকসিন ৬ ধাপে সরাসরি বাংলাদেশের নির্ধারিত জেলার ইপিআই সেন্টারে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এমএইচএস/এনএফ