ভিকটিম হলে লুকিয়ে থাকবেন না : আইজিপি
সাইবার ওয়ার্ল্ডে কোনো নারী হয়রানির শিকার হলে লুকিয়ে না থেকে তাকে পুলিশের সহায়তা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ।
মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) বেলা ১২টায় পুলিশ সদর দফতরে ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন’-এর বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
বিজ্ঞাপন
বেনজীর আহমেদ বলেন, আমরা চাই না কোনো নারী-পুরুষ ভিকটিম হোক। তারপরেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো নারী যদি ভিকটিম হয়েই যান তাহলে সেটি লুকিয়ে রাখবেন না। আমরা চাই অপরাধীদের শাস্তি হোক। সামাজিক কারণে অনেকেই এ সংক্রান্ত বিষয়ে মামলা-মোকদ্দমা করতে চায় না। তরুণ মেয়েরাই মূলত ভিকটিম হচ্ছে বেশি। সমাজ বা সম্মানের ভয়ে তারা অভিযোগ করতে চায় না। সবচেয়ে মুশকিল হয় তখনই, যখন অপরাধীকে শনাক্ত করার পরে ভিকটিক পিছু হটে। তাই আমাদেরকে এটা মোকাবিলা করতে হবে। সামাজিক ট্যাবু ভাঙতে হবে।
তিনি বলেন, সাইবার ওয়ার্ল্ডে নানা ধরনের প্রোপাগান্ডায় রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও সমাজ ভিকটিম হচ্ছে। সাইবার বুলিং ও সাইবার সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে নারীরা সবচেয়ে বড় ভিকটিম। এই প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। অনেকে বুঝতেই পারেন না, তারা এই সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন। যারা এই সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন তারাই বুঝতে পারেন কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছেন। এর ফলে ব্যক্তির মানবিক-মানসিক বিপর্যয় ঘটে।
ইন্টারনেট ব্যবহারের সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আইজিপি বলেন, এক তরুণী ফেসবুকে নিজের অনেকগুলো ছবি আপলোড করেছেন, অথচ তিনি জানেন না ফেসবুকের সেফটি কী। তার অজান্তেই কেউ একজন ছবিগুলো কপি করে একটি ন্যুড কমার্শিয়াল সাইটে দিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছ। ওই নারী তখনই জানতে পেরেছেন, যখন বিয়ে-সাদির বিষয়টি এসেছে। পরে ওই নারীকে আমরা সাইবার সাপোর্ট দিয়ে সাইটটি ব্লক করে সহায়তা করার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি এ ধরনের ঝুঁকি যেগুলো আছে, সেসব ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে হবে। কোনো ব্যক্তিগত তথ্য সামাজিক মাধ্যমে একবার যদি ছড়িয়ে পড়ে, কোটি কোটি মানুষের কাছে চলে যায়। হয়তো একটা আইডি ব্লক করা গেল, কিন্তু ওই আইডি থেকে কোটি কোটি শেয়ার-ট্যাগ হয়ে যায়।
পুরুষ-নারী সবাইকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করার আগে তার ঝুঁকি এবং নিরাপত্তার বিষয়টি জানতে হবে। তা না জেনে অপরিচিত পৃথিবীতে ঝাঁপ না দেওয়ার কথা বলেন আইজিপি।
পুলিশ প্রধান বলেন, যত বেশি আমাদের দেশে ডাটাবেইজ ব্যবহৃত হবে তত বেশি ঝুঁকি বাড়বে। কিছুদিন আগে আমাদের দেশে ই-কমার্সের জোয়ার বয়ে গেল। সেখানে কেনাটাকা করতে গিয়ে কোটি কোটি মানুষ তাদেরকে প্রাইভেট তথ্য দিয়ে দিয়েছি। এ সমস্ত ই-কমার্স সাইটের কাছে এখন লাখ লাখ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য রয়েছে। এ তথ্যের সিকিউরিটি কী? সেসব ফোন নাম্বার, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, মোবাইল ব্যাংকিং, ঠিকানা যদি থার্ড পার্টির হাতে যায়, তাহলে সেসব আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। এই ঝুঁকি স্বাভাবিক অপরাধের চেয়েও বেশি। তাই যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন সেখানে কোনো ধরনের অপরিচিত মানুষকে অ্যাক্সেস দিবেন না। কারো বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে আপনার নিজস্ব নেটওয়ার্কে কাউকে এন্ট্রি দিবেন না। দেখা গেলো ফেসবুকে কারো সঙ্গে এক-দুদিনের পরিচয়, এরপরই দেখা করতে বেরিয়ে পড়েন। সেসব ক্ষেত্রে অনেকে ভিকটিম হয়েছেন।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার ১২ হাজার ৬৪১ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ জিডি বা মামলা করেছেন। এর মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্তের আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৭ হাজার ২৮০ জন সেবাপ্রত্যাশী যোগাযোগ করেছেন। হয়রানি-সংক্রান্ত ১২ হাজার ৬৪১ অভিযোগের মধ্যে আট হাজার ২২১ জনকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
এক বছরে যারা অভিযোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে হয়রানি করার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি, যা মোট অভিযোগের ৪৩ শতাংশ বা পাঁচ হাজার ৪৭৫ জন। এ সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে এক হাজার ৮৮৪ জন নারীকে। আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানি করা হয় ৯৯২ জনকে। অন্যান্য উপায়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন এক হাজার ৫১৮ জন।
অভিযোগকারীর শতকরা ১৬ ভাগ ১৮ বছরের কম বয়সী। শতকরা ৫৮ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। ২৫-৩০ এর মধ্যে ভুক্তভোগী ২০ ভাগ এবং ৬ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৪০ বছরের বেশি।
ঢাকা বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভুক্তভোগী এই সেলে অভিযোগ করেছেন, যা মোট অভিযোগের ৬৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ১৭ শতাংশ; খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগ থেকে ৪ শতাংশ; বরিশাল থেকে ৩ শতাংশ ও ময়মনসিংহ থেকে ২ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ‘সাইবার স্পেস নারীসেবা’ প্রতিপাদ্য নিয়ে একবছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন। বাংলাদেশ পুলিশ অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে বিশ্বাসী নারীর বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধ রোধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। নারীর জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস নির্মাণে ভূমিকা রাখতে এক বছরের পথ অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ পুলিশের ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’।
অনুষ্ঠানে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজি, ডিআইজি এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি এবং পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের সেবাগ্রহীতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া, সারা দেশ থেকে বাংলাদেশ পুলিশের সকল ইউনিট ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিল। অনুষ্ঠানে ফেসবুক পেজটির গত এক বছরের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়।
এমএসি/এইচকে