যে কারণে কারাগারে নজরদারি চায় সিটিটিসি
গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেফতারও হয়েছেন দুই হাজারের মতো জঙ্গি সদস্য। বন্দুকযুদ্ধে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে।
জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি করা এসব সফলতার মাঝেও রয়েছে দুশ্চিন্তার রেখা। এর পেছনে দুটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেখানে নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গি-মতাদর্শ। আরেকটি হলো কারাগার।
বিজ্ঞাপন
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, হলি আর্টিজানে হামলার পর নব্য জেএমবি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের প্রায় দুই হাজার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমানে এদের প্রায় এক হাজার জন জামিনে রয়েছেন। বাকিরা গাজীপুরের কাশিমপুরসহ বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
কাশিমপুর কারাগার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাথাব্যথা রয়েছে। কেননা, সেখানে অর্ধশতাধিক দুর্ধর্ষ জঙ্গি রয়েছে। তারা নব্য জঙ্গির গ্রেফতার সদস্যদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে জঙ্গিরা জামিনে বের হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করছে।
কাশিমপুর কারাগার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাথাব্যথা রয়েছে। কেননা, সেখানে অর্ধশতাধিক দুর্ধর্ষ জঙ্গি রয়েছে। তারা নব্য জঙ্গির গ্রেফতার সদস্যদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে জঙ্গিরা জামিনে বের হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করছে।
এমনই এক জঙ্গি সদস্য নব্য জেএমবির সামরিক শাখার কমান্ডার আব্দুল্লাহ আল নোমান ওরফে আবু বাছির। গত ৩ নভেম্বর মিরপুর বাজার রোড এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
২০১৭ সালে ফেসবুক ও ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও পেয়ে জঙ্গিবাদে জড়ান বাছির। জঙ্গিবাদে জড়ানোর অভিযোগে ২০১৮ সালে তাকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। গ্রেফতারের পর এক বছর তিন মাস ছিলেন কাশিমপুর কারাগারে। সেখানে জঙ্গি সেলে আরও জঙ্গি সদস্যদের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন বাছির।
জামিনে বের হয়ে বাছির সরাসরি যোগাযোগ করেন নব্য জেএমবির আমির মাহাদী হাসান ওরফে জনের সঙ্গে। পরে তার যোগাযোগ হয় নব্য জেএমবির শুরা সদস্য আবু মোহাম্মদের সঙ্গে। তাদের নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণে ২০২০ সালের ২৪ জুলাই রাতে পুরানা পল্টনে পুলিশ চেকপোস্টের পাশে রিমোট নিয়ন্ত্রিত বোমা রেখে শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটান বাছির।
গ্রেফতার নতুন সদস্যদের অপেক্ষায় থাকে কারাগারের জঙ্গিরা
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, নব্য জঙ্গিরা নানা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হচ্ছে। কারাগারে থাকা দুর্ধর্ষরা তাদের অপেক্ষায় থাকে। কাশিমপুর কারাগারে বন্দি জঙ্গিদের আলাদা এক জগৎ। কৌশলে তারা সেখানে স্মার্টফোন-ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করে নেয়। আর এসবের মাধ্যমেই তারা নতুন জঙ্গিদের গ্রেফতারের বিষয়টি জানতে পারে।
গ্রেফতারের পর নতুন জঙ্গিরা যখন কারাগারে যায়, তখন পুরোনোরা তাদের জন্য লুঙ্গি-শার্ট থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে। নতুনদের ‘ব্রেনওয়াশ’ শেষে দুর্ধর্ষ জঙ্গি বানিয়ে জামিনে বের করা হয়। জামিনে বের হয়ে এ জঙ্গিরা সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সহায়তায় বড় হামলার পরিকল্পনা করে এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে।
গ্রেফতারের পর নতুন জঙ্গিরা যখন কারাগারে যায়, তখন পুরোনোরা তাদের জন্য লুঙ্গি-শার্ট থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে। নতুনদের ‘ব্রেনওয়াশ’ শেষে দুর্ধর্ষ জঙ্গি বানিয়ে জামিনে বের করা হয়। জামিনে বের হয়ে এ জঙ্গিরা সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সহায়তায় বড় হামলার পরিকল্পনা করে এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে।
কারাগার থেকেই শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, কারাগারে থাকা জঙ্গিরা নানা কৌশলে তাদের সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। এ দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে নব্য জেএমবির সদস্যরা। গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী, তুরস্কে থাকা জেএমবির আমির মাহাদী হাসান ওরফে জনের সঙ্গে তারা কারাগারে বসেই নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে।
তুরস্কে বসেই কারাগারে থাকা জঙ্গিদের দিক নির্দেশনা দেন মাহাদী হাসান ওরফে জন। তার নির্দেশেই কারাগারে নব্য জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জামিনে বের করা হয়। জামিনে বের হয় নব্য জঙ্গিরা সরাসরি মাহাদী হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে।
কারাগারে কেন নজরদারি করতে চায় সিটিটিসি
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, সদ্য জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়া তরুণরা যেন দুর্ধর্ষ জঙ্গি না হয়ে ওঠে, সেজন্য সিটিটিসি কারাগারে নজরদারি করতে চায়। সিটিটিসি চায়, সদ্য জঙ্গিবাদে জড়ানো তরুণদের কারাগারে দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের সেলে না পাঠিয়ে তাদের আলাদা রাখতে। তাহলে তাদের কাউন্সিলিং করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যাবে।
অন্যদিকে দুর্ধর্ষ যে জঙ্গিরা কারাগারে রয়েছে, তাদের কঠিন নজরদারির মধ্যে রাখলে জঙ্গি কার্যক্রম চালাতে পারবে না বলে মনে করছে সিটিটিসি। এক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা নিয়ে কাজটি করতে চায় সিটিটিসি।
এ বিষয়ে সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জামিন পাওয়া অনেক জঙ্গি আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। কোনো জঙ্গির জামিন পাওয়ার পর আমরা দেখি, সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে কি না। নাকি পুনরায় সংগঠনের কাজ-কর্মে যুক্ত হয়েছে। যাকে নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি, তাদের নজরদারিতে রাখি।
তিনি বলেন, কারাগারে আমরা নজরদারি করতে পারি না, কারণ আমাদের সেই অনুমতি নেই। তবে আমরা কারাগারে নজরদারি করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠি দিয়েছি। কীভাবে কারাগারে থাকা জঙ্গিদের ডি-রেডিক্যালাইজেশন করা যায় এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করব। আশা করছি, এ বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক সাড়া পাব।
কারা কর্তৃপক্ষের সহায়তা পাচ্ছে না সিটিটিসি!
সিটিটিসি বলছে, কারাগার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকে দুর্ধর্ষ জঙ্গি হয়ে জামিনে বের হয়ে আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে। কারাগারের বাইরে নজরদারি করা সম্ভব হলেও ভেতরে সম্ভব হচ্ছে না। যেহেতু কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অন্য কোনো সংস্থা নজরদারি করতে পারে না, সেজন্য সিটিটিসির পক্ষেও তা সম্ভব হচ্ছে না।
কারাগারে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, এমন কয়েকজনকে নজরদারি করার জন্য সিটিটিসি কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটিটিসির এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রেফতারের পর কারাগারে জঙ্গিরা চলে গেলে আমাদের হাতে আর কিছু থাকে না। কিন্তু আমাদের কাছে প্রায়ই গোয়েন্দা তথ্য আসে, কারাগারে থেকে জঙ্গিরা বাইরে হামলার পরিকল্পনা করছে। তবে আমরা কারা-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও নজরদারির বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারিনি।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত আইজি প্রিজন কর্নেল আকবর হোসেন বলেন, দেশের কারাগারে আটক থাকা জঙ্গিদের বিশেষ নজরদারিতে রাখা হয়। এরপরও কারাগারে নজরদারি সংক্রান্ত একটি চিঠি সিটিটিসি পাঠিয়েছে। এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমরা আরেকটি চিঠি পাঠিয়েছি। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এমএসি/আরএইচ