‘প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় ঘটছে সাম্প্রদায়িক হামলা’
অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এটাকে বারবার বিপথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে সরকারি দলসহ বিভিন্ন দল জড়িত। উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাজনীতি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল ও লুটপাট। প্রশাসনে কারা বসে আছেন, তাদের মতলবটা কী আমরা বুঝি না। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় ঘটছে সাম্প্রদায়িক হামলা। প্রশাসন যদি সক্রিয় থাকত, একটি সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটতে পারত না।
শনিবার (০৬ নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রামের ডিসি হিলের মুক্তাঙ্গনে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে এ কথা বলে বক্তারা। ‘সর্বস্তরের সাংস্কৃতিক কর্মী ও সচেতন নাগরিক সমাজ’ ব্যানারে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বিজ্ঞাপন
সমাবেশে কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, আমরা ১৯৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই সংগ্রাম করেছি। ছয় দফা থেকে যে উত্তরণ ঘটেছে এ জাতির, সেটাও ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান মিলিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমরা, আদিবাসীরাও মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ফলে এই ভূখণ্ডের সকল মানুষের দেশ এটি। এ দেশে রাষ্ট্রধর্ম কেন থাকবে? রাষ্ট্র গঠিত হয় তিনটা অঙ্গ নিয়ে, প্রশাসন, আইনসভা এবং বিচার বিভাগ। প্রশাসনের পরিচালনায় থাকে সরকার। সেটি গণতন্ত্রে জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার কথা। কাজেই এই অঙ্গগুলোর তো ধর্ম পালনের কোনো সুযোগ নেই। এগুলোকে প্রত্যেক ধর্মের মানুষকে সেবা দিতে হবে। প্রত্যেক ধর্মের মানুষই তাদের কাছ থেকে কোনো না কোনো সেবা লাভ করে। এখানে বিভেদ সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না।
তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করতে হবে। এটাই আমাদের আজকের আয়োজনের মূল বিষয়। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সব ধর্মের মানুষ মিলে বাঙালি জাতীয়তার জাগরণ, বাঙালি ঐতিহ্যের লালন, আমাদের চেতনাকে পুনরায় জাগ্রত করতে আরও অনেক কাজ করতে হবে।
সমাবেশে শহীদ জায়া বেগম মুশতারি শফী বলেন, আজ বাংলাদেশের চেহারা দেখে নিজের বড় খারাপ লাগে। আমরা শিশুকাল থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বড় হয়েছি, আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখেছিলাম। আমরা মুসলমান, আমরা নামাজ পড়ি, আমরা রোজা রাখি। আমরা যে যার ধর্ম পালন করলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করি। আমার বাসার সামনে একটি মন্দির। ডান পাশে আরেকটি মন্দির। তারা পূজা করছে, আমরা নামাজ পড়ছি, আমাদের কিংবা তাদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ছেলেবেলা থেকেই এই শিক্ষাটা পেয়েছি। এই শিক্ষা নিয়েই ধর্ম পালন করছি। আমরা মানুষকে ভালোবেসেছি।
তিনি বলেন, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- কাউকে যেন আলাদা করে দেখা না হয়, আমরা সবাই মানুষ। এই বাংলাদেশকে শান্তির বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চাই।
আবুল মোমেন বলেন, সমাবেশে একটা কথা উঠেছে, ভোট এবং সম্পত্তির জন্যই সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটানো হয়েছে। এর ফলে বিভেদ আমাদের সমাজে বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে। এ অবস্থায় সমাজের পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, স্বৈরশাসক এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে দেশের বাকি নাগরিকদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এরপর থেকে ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসার এবং থাকার পথ তৈরি হয়েছে। সমাজে ধর্মীয় উগ্রবাদ বেড়েছে। এটা যে শুধু মুসলমানদের মধ্যে তা নয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। এই সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত করেছে।
তিনি বলেন, আজ ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললে ধর্মহীনতার কথা নিয়ে আসা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে জাতির মধ্যে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তোলা হয়েছিল, আজ আবারও সেই জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। দেশকে সেই অসাম্প্রদায়িক জাগরণের জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। গণসমাবেশে শেষে ডিসি হিল থেকে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যান বিশিষ্টজন ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা। আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসানের সঞ্চালনায় সমাবেশের শুরুতে উদীচী ও রক্তকরবী সংগঠনের শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
কেএম/এসকেডি