যাত্রী জিম্মি করে ‘গাড়ি বন্ধ’ আইন পরিপন্থী
সড়ক পরিবহন মালিকদের বাস-মিনিবাস, ট্রাকসহ পণ্যবাহী গাড়ি শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে সারা দেশে বন্ধ রয়েছে। পরিবহন শ্রমিকেরা বাস-ট্রাকসহ পণ্যবাহী গাড়ি চালাচ্ছেন না। দেশে বাস ও মিনিবাস বন্ধ রাখা হয়েছে আগাম ঘোষণা ছাড়া।
শ্রম অধিদফতর ও বিভিন্ন পরিবহন সংগঠনের নেতারা বলছেন, এভাবে কৌশলে গাড়ি বন্ধ রাখা বা ‘অবৈধ ধর্মঘট’ অন্যায়। তা কোনোভাবেই আইনসম্মত নয়।
বিজ্ঞাপন
তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেছেন, ‘আমরা ধর্মঘট বা কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করিনি। বাস ও মিনিবাস মালিকরা অতিরিক্ত দামের ডিজেলে গাড়ি চালাতে চান না। সেটা আমাদের জানিয়েছেন।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাবেক নৌ-মন্ত্রী শাহজাহান খান ঢাকা পোস্টকে বলেছেন, ‘আমরা পরিবহন ধর্মঘটের কোনো ঘোষণা দেইনি। মালিকরা গাড়ি না চালালে আমাদের কী করার আছে? আমরা সমস্যার দ্রুত সমাধান চাই।’
জানা গেছে, গাড়ি বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে পরিবহন খাতের শীর্ষ বিভিন্ন নেতার সায় রয়েছে। এটা জনস্বার্থ বিরোধী। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের ধর্মঘট পরিস্থিতি তৈরির পেছনের পরিবহন নেতাদের সম্মতি রয়েছে বলেই সাধারণ মানুষ মনে করছেন।’
দেশে সাধারণ মানুষদের জিম্মি করে পরিবহন মালিকরা মুনাফা লুটের জন্যই গাড়ি বন্ধ রেখেছেন। সারা দেশের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ সড়কপথে প্রায় বিচ্ছিন্ন।
শ্রম অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ধর্মঘট ডাকতে হলে শ্রমিকদের ক্ষেত্রে দাবিনামা যেমন সংশ্লিষ্ট অধিদফতরকে অবহিত করতে হয় তেমনি মালিকপক্ষকেও ধর্মঘট ডাকার আগে তা শ্রম অধিদফতরকে জানাতে হয়।
আইন অনুযায়ী, পরিবহন মালিকদের দাবিনামা জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা জানাতে হবে শ্রম অধিদফতর ছাড়াও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), ঢাকা মহানগর পুলিশ ও বিভিন্ন জেলা পুলিশ কার্যালয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিআরটিএ থেকেই গাড়ির রুট পারমিট অনুমোদন করা হয়। এ জন্য রয়েছে আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি)। এ কমিটিতে পুলিশ প্রশাসনের প্রতিনিধিও থাকেন। এবার সড়কে কৌশলে পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু ধর্মঘট ডাকার ক্ষেত্রে এসব সংস্থাকে দাবিনামা জানানো হয়নি।
শ্রম অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেছেন, নিবন্ধিত কোনো সংগঠন ধর্মঘট আহ্বান করলে শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে, তা শ্রম অধিদফতরকে অবহিত করতে হয়। সংক্ষুব্ধদের দাবিনামাসহ ত্রিপক্ষীয় একটি বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় সুরাহা না হলে ধর্মঘট আহ্বান করা যায় বিভিন্ন শর্ত মেনে।
বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান বলেন, ‘বিআরটিএ থেকে অনুমোদন দেওয়া বাস মালিকদের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি ব্যবস্থা নিতে পারে। আগাম নোটিশ না দিয়ে ধর্মঘট আহ্বান অন্যায়। তা করা হলে আরটিসি রুট পারমিট বাতিল করতে পারে। আমাদের দেশে তা করা হয় না বলে যেকোনো সময় কৌশলে গাড়ি বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালন করা হয়।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি জনাব মোহাম্মদ হানিফ (খোকন) বলেন, ‘শ্রম অধিদফতরে নিবন্ধিত সংগঠনগুলোর নিজ নিজ গঠনতন্ত্র থাকে। গঠনতন্ত্রে ধর্মঘট আহ্বানের নিয়মটি শ্রম আইনের আলোকে করা হয়েছে। ধর্মঘট আহ্বানের ক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিয়ন বা ফেডারেশনকে সাধারণ সভা আহ্বান করতে হয়। সাধারণ সভায় উপস্থিত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ধর্মঘটের পক্ষে ভোট প্রদান করলে ১৫ কর্মদিবসের আল্টিমেটাম দিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে দাবিনামা পেশ করতে হয়। পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ন্যায়সংগত দাবি মেনে না নিলে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন ধর্মঘট আহ্বান করতে পারে। এখন দেশের জনগণকে জিম্মি করে যে অঘোষিত ধর্মঘট পালন করা হচ্ছে তা শ্রম আইনের পরিপন্থী।’
আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেও ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আগাম ঘোষণা ছাড়া সারা দেশে গাড়ি চলাচল বন্ধ করেছিলেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। ধর্মঘটের আগে আইন অনুসরণ করা হয়নি।
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন মানিকগঞ্জের আদালত। ওই সাজার প্রতিবাদে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পরিবহন ধর্মঘট শুরু করেছিলেন পরিবহন খাতের শ্রমিকরা।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে হাইকোর্টে ২০১৭ সালের ১ মার্চ রিট আবেদন করা হয়েছিল। এতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার, ধর্মঘট প্রত্যাহার না করলে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল এবং মালিকদের গাড়ি জব্দ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। পরে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।
পিএসডি/ওএফ