চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর কাট্টলী এলাকায় গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে আগুনে দগ্ধ একই পরিবারের চারজন বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছে। নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ জামাল শেখ তাদের চিকিৎসার খরচ চালাতে পারছে না। পরিবারটির এই অসহায় অবস্থার কথা শুনে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।

বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) বিকেলে অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীরের পক্ষ থেকে পরিবারটিকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহির হোসেন পুলিশ কমিশনারের পক্ষ হয়ে দগ্ধ পরিবারের অভিভাবক জামাল শেখের হাতে টাকা তুলে দেন।

ওসি জহির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবারটি খুব অসহায়। জামাল শেখ সামান্য বেতনের চাকরি করেন। দগ্ধদের চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। একথা শুনে কমিশনার স্যার তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। 

মোহাম্মদ জামাল শেখ বলেন, আমি সামন্য বেতনের চাকরি করি। আমার বড় ছেলে ওয়ার্কশপে কাজ করত। আমরা যা ইনকাম করতাম তার দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু এখন তাদের চিকিৎসায় প্রতিদিন অনেক টাকা যাচ্ছে। একদিনেই ১৭ হাজার টাকার ওষুধ এনেছি। চিকিৎসার খরচ চালাতে পারছি না- একথা শুনে পুলিশ কমিশনার স্যার এগিয়ে এসেছেন। এছাড়া আরও কয়েকজন কিছু টাকা দিয়েছেন। সামনে কীভাবে টাকা জোগাড় করব তা নিয়ে চিন্তায় আছি।

এ ঘটনায় দুজনকে আসামি করে নগরীর আকবর শাহ থানায় মামলা দায়ের করেছেন দগ্ধের ঘটনায় মারা যাওয়া সাজেদা বেগমের স্বামী মোহাম্মদ জামাল শেখ। বাড়ির মালিক মো. মমতাজ মিয়া সওদাগরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে একদিনের রিমান্ড শেষে বৃহস্পতিবার মমতাজ মিয়া আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন আকবর শাহ থানার ওসি জহির হোসেন। 

উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর কাট্টলী এলাকায় গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ছয়জন দগ্ধ হয়েছিলেন। চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর কাট্টলী কমিউনিটি সেন্টার রোডে মরিয়ম ভিলার ষষ্ঠ তলায় ভাড়াটিয়া জামাল শেখের বাসায় এ ঘটনা ঘটে।

আগুনে দগ্ধ সাজেদা বেগম (৪৮) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এ ঘটনায় দগ্ধ ছেলে সানি (২৯), স্বাধীন (১৭) ও জীবন (১৫) ও মেয়ে মাহি (১০) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর বড় ছেলের স্ত্রী দিলরুবাকে (২৪) চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

দগ্ধদের পরিবারের অভিযোগ, গ্যাসের লাইনে লিকেজের বিষয়টি একাধিকবার ভবনের কেয়ারটেকারকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একটু সচেতন হলেই এড়ানো যেত এ দুর্ঘটনা। জানা গেছে, গত বছরও একই ভবনে গ্যাস লাইন লিকেজের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। দগ্ধ হয়েছিলেন দুই পরিবারের ৯ জন। এতে দুজন প্রাণ হারিয়েছিলেন।

চমেক হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিক উদ্দিন আহমদ ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, সোমবার রাতে দগ্ধ হওয়া ছয় জনের মধ্যে পাঁচ জনেরই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে, অবস্থা আশঙ্কাজনক। দগ্ধদের শরীরের সাত শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গেছে।

দগ্ধদের মধ্যে মারা যাওয়া সাজেদা বেগমের শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। আর তার ছেলে স্বাধীনের ৪২ শতাংশ ও জীবনের ৪০ শতাংশ এবং মেয়ে মাহিয়ার ৩৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। এছাড়া সানির ২০ শতাংশ ও তার স্ত্রী দিলরুবার শরীরের ৭ শতাংশ পুড়ে গেছে।

সাজেদা বেগমের মেজো ছেলে লিমন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক সপ্তাহ আগে বাসায় গ্যাসের গন্ধ পেয়ে বাড়ির কেয়ারটেকারকে বিষয়টি জানিয়েছি। তাকে বাসায় এসে গ্যাসের লিকেজের বিষয়টি দেখার অনুরোধ করি। কেয়ারটেকার এসে দেখে বলেন, এটি কোনো সমস্যা নয়।

তিনি বলেন, দুর্ঘটনার দুই দিন আগে কেয়ারটেকারকে গ্যাস লিকেজ হওয়ার বিষয়টি আবারও জানিয়েছি। তাকে বলেছি, গ্যাসের গন্ধটা আরও বেশি হচ্ছে। কেয়ারটেকার আবারও আমাদের অভিযোগকে গুরুত্ব না দিয়ে ‘সমস্যা নেই’ বলে চলে যান। সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনার সময় সবাই গল্প করছিল। এ সময় আমি বাথরুমে থাকায় বেঁচে যাই।

তিনি আরও বলেন, আমার ছোটবোন মশা মারার ব্যাট দিয়ে মশা মারছিল। সে সময় দরজা-জানালা সব বন্ধ ছিল। যে কারণে লিকেজের গ্যাস বাসা থেকে বের হতে পারেনি। মশা মারার সময় ব্যাট থেকে যে আগুনটা হয় তাতেই পুরো ঘর জ্বলে গেছে। যাদের অবহেলার কারণে আমার পরিবারের ছয় জন দগ্ধ হলেন আমি তাদের বিচার চাই।

সাজেদা বেগমের স্বামী মোহাম্মদ জামাল শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার সময় আমি বাইরে থাকায় বেঁচে গেছি। আমার হাসিখুশি পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বাড়ির কেয়ারটেকারকে আমিও বাসায় গ্যাসের গন্ধ পাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছিলাম। বিষয়টি নিয়ে আমরা ভবন মালিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। সময়মত ব্যবস্থা নিলে আমার পরিবার রক্ষা পেত।

কেএম/ওএফ