এক সপ্তাহ ধরে বাসায় গ্যাসের গন্ধ। কেয়ারটেকারকে জানালে বললেন, ‘এটি কোনো সমস্যা নয়’। গ্যাসের গন্ধ বাড়তে থাকল। ফের জানালে ‘সমস্যা নেই’ বলে এড়িয়ে গেলেন। ভবন মালিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলো, তাকে পাওয়া গেল না। তবে লিকেজ থেকে গ্যাস বের হওয়া থেমে থাকল না। 

এর চরম মূল্য দিতে হলো সোমবার (১ নভেম্বর) রাতে। সে সময় বন্ধ ছিল বাসার দরজা-জানালা। ঘরে জমা হচ্ছিল গ্যাস। মশা মারতে ইলেকট্রিক ব্যাট ব্যবহার করা হয়। ব্যাটের স্পার্ক থেকে মুহূর্তেই ঘরে জমা গ্যাসে আগুন ধরে বিস্ফোরণ ঘটে। ভেঙে যায় দরজা-জানালা। দগ্ধ হন পরিবারের ছয় সদস্য।

সোমবার রাতের এই দুর্ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর কাট্টলী কমিউনিটি সেন্টার রোডে মরিয়ম ভিলার ষষ্ঠ তলায় ভাড়াটিয়া জামাল শেখের বাসায়। জামাল স্থানীয় হাক্কানি আয়রন মার্টের নিরাপত্তাকর্মী। পুলিশ জানিয়েছে, তার বাড়ি জামালপুরে।  

আগুনে দগ্ধরা হলেন- মা সাজেদা বেগম (৪৮), ছেলে সানি (২৯), স্বাধীন (১৭) ও জীবন (১৫); মেয়ে মাহি (১০) এবং বড় ছেলের স্ত্রী দিলরুবা (২৪)। রাত ১২টার দিকে তাদের সবাইকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে নেওয়া হয়। পাঁচ জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।

দগ্ধদের পরিবারের অভিযোগ, গ্যাসের লাইনে লিকেজের বিষয়টি একাধিকবার ভবনের কেয়ারটেকারকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একটু সচেতন হলেই এড়ানো যেত এই দুর্ঘটনা। এদিকে জানা গেছে, গত বছরও একই ভবনে গ্যাস লাইন লিকেজের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। আগুনে দগ্ধ হয়েছিলেন দুই পরিবারের ৯ জন। এতে প্রাণ হারিয়েছিলেন দুই জন। 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিক উদ্দিন আহমদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোমবার রাতে দগ্ধ হওয়া ছয় জনের মধ্যে পাঁচ জনেরই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে, অবস্থা আশঙ্কাজনক। দগ্ধদের শরীরের সাত শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত পুড়েছে।  

দগ্ধদের মধ্যে সাজেদা বেগমের শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার ছেলে স্বাধীনের ৪২ শতাংশ ও জীবনের ৪০ শতাংশ এবং মেয়ে মাহিয়ার ৩৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। এছাড়া সানির ২০ শতাংশ ও তার স্ত্রী দিলরুবার শরীরের ৭ শতাংশ পুড়ে গেছে।

সাজেদা বেগমের মেজো ছেলে লিমন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক সপ্তাহ আগে বাসায় গ্যাসের গন্ধ পেয়ে বাড়ির কেয়ারটেকারকে বিষয়টি জানিয়েছি। তাকে বাসায় এসে গ্যাসের লিকেজের বিষয়টি দেখার অনুরোধ করি। কেয়ারটেকার এসে দেখে বলেন, এটি কোনো সমস্যা নয়। 

তিনি বলেন, দুর্ঘটনার দুই দিন আগে কেয়ারটেকারকে গ্যাস লিকেজ হওয়ার বিষয়টি আবারও জানিয়েছি। তাকে বলেছি, গ্যাসের গন্ধটা আরও বেশি হচ্ছে। কেয়ারটেকার আবারও আমাদের অভিযোগকে গুরুত্ব না দিয়ে ‘সমস্যা নেই’ বলে চলে যান। গতকাল (সোমবার) রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনার সময় সবাই গল্প করছিলেন। এই সময় আমি বাথরুমে থাকায় বেঁচে যাই।

তিনি আরও বলেন, আমার ছোটবোন মশা মারার ব্যাট দিয়ে মশা মারছিল। সে সময় দরজা-জানালা সব বন্ধ ছিল। যে কারণে লিকেজের গ্যাস বাসা থেকে বের হতে পারেনি। মশা মারার সময় ব্যাট থেকে যে আগুনটা হয় তাতেই পুরো ঘর জ্বলে গেছে। তিনি আরও বলেন, যাদের অবহেলার কারণে আমার পরিবারের ছয় জন দগ্ধ হলেন আমি তাদের বিচার চাই।

সাজেদা বেগমের স্বামী মোহাম্মদ জামাল শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার সময় আমি বাহিরে থাকায় বেঁচে গেছি। আমার হাসিখুশি পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বাড়ির কেয়ারটেকারকে আমিও বাসায় গ্যাসের গন্ধ পাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছিলাম। তখন তিনি বলেছিলেন, বাহিরের গ্যাসের গন্ধ। বিষয়টি নিয়ে আমরা ভবন মালিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। সে সময় ব্যবস্থা নিলে আমার পরিবার রক্ষা পেত। 

তিনি বলেন, আমি চিকিৎসার টাকা জোগাড় করা নিয়ে টেনশনে আছি। বাড়ির মালিকরা রাতে এসে আমার পরিবারের দগ্ধদের দেখে গিয়েছিল। আর খোঁজ নেয়নি।

চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দগ্ধদের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেছি। তারা বলেছেন গ্যাস লিকেজ থেকে এই ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা বাড়ির মালিক ও ভবনের কেয়ারটেকারকে থানায় এনেছি। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। 

কেএম/এইচকে/জেএস